
ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তি কুন্দনলাল সায়গল, যাঁকে বলিউডের প্রথম সুপারস্টার বলা যায়, জীবনের শেষদিকে পড়েছিলেন এক ভয়ংকর নেশার জালে। মাত্র ৪২ বছর বয়সে, ভারতের স্বাধীনতার বছরে, তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন; পেছনে ফেলে যান তাঁর অনন্য সব স্মৃতি।
কুন্দনলাল সায়গল বা কে এল সায়গলের জন্ম জম্মুতে। ১৯৩৫ সালে নির্মিত ‘দেবদাস’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ছুঁয়ে ফেলেন জনপ্রিয়তার শিখর। তবে বাস্তব জীবনে তিনি ছিলেন যেন এক নিঃসঙ্গ দেবদাস; নেশার ঘোরে নিজেকে নিঃশেষ করে তোলা এক প্রতিভাবান মানুষ।
কলকাতা থেকে উত্থান
জীবনের শুরুতে জলন্ধরে বিভিন্ন খুচরা কাজ করতেন সায়গল। কখনো শিমলার হোটেলে কাজ, কখনো শাড়ি ও টাইপরাইটার বিক্রির সেলসম্যান। তবে গান ছিল তাঁর প্রাণ, আর সেই টানেই চলে যান কলকাতায়। তখনকার বিনোদন জগতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শহর।
কলকাতায় নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে মাসে ২০০ টাকার চুক্তিতে যুক্ত হন সায়গল। প্রথম দিকে সিনেমাগুলো সাড়া ফেলেনি, কিন্তু ১৯৩৪ সালে ‘চণ্ডীদাস’ ছবির গান ‘প্রেম নগর’ হিট হয়ে যায়। পরের বছরই আসে তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানো ছবি ‘দেবদাস’।
‘আমি গাই শরীর দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে’
কিদার শর্মাকে একবার সায়গল বলেছিলেন, ‘আমি কোনো অভিনেতা নই। আগে সেলসম্যান ছিলাম, গান গাওয়া ছিল শখ।’ কিদার শর্মা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘সায়গলের জীবনে দুটি নেশা ছিল, সংগীত আর মদ। একটি তাঁকে গড়ে তুলেছিল, আর অন্যটি শেষ করে দিয়েছিল।’
সায়গল বিশ্বাস করতেন, তিনি শুধু মদ্যপ অবস্থায়ই গান গাইতে পারেন। সুরকার নওশাদ একবার তাঁকে একই গান একবার নেশায়, আরেকবার নেশা ছাড়া গাইতে বলেন।
একবার সায়গল এক সুরকারকে বলেছিলেন, ‘ক্ষমা করবেন, আমি হয়তো টলছি; কিন্তু আমি গাই শরীর দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে।’
সরাসরি রেকর্ডিংয়ে
সায়গল চাইতেন গান সরাসরি রেকর্ড করতে। ১৯৩৮ সালের ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’ ছবির বিখ্যাত ‘বাবুল মোরা নাইহার ছুটো হি যায়’ গানটি তিনি হাঁটতে হাঁটতে লাইভ রেকর্ড করান। ট্রাকে মাইক বসিয়ে তাঁর পেছনে চলা হয়। সেই সময়ের জন্য এই সাহস ছিল অদ্বিতীয়।
অনুভূতির মানুষ
একসময় শাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে এক দরিদ্র মেয়েকে একটি সবুজ শাড়ি পছন্দ করতে দেখেন সায়গল। মেয়েটি প্রতিশ্রুতি দেয় যে পরদিন ১০ রুপি জোগাড় করে শাড়িটি কিনবে। কিন্তু পরদিন গিয়ে সায়গল জানতে পারেন যে মেয়েটি মারা গেছে। কেঁদে ফেলেন সায়গল, সেই শাড়ি দেন মেয়েটির দাফনে, এরপর আর কোনো দিন শাড়ি বিক্রি করেননি তিনি।
একবার রাতে এক পার্টি থেকে বেরিয়ে কিদার শর্মাকে নিয়ে গান শোনার জন্য এক অন্ধ ভিক্ষুকের কাছে যান সায়গল। গান শুনে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে নিজের পকেটের সব টাকা ওই ভিক্ষুককে দিয়ে দেন। পরে জানান, তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন পাঁচ হাজার রুপি। কিদার বিস্মিত হলে সায়গল বলেন, ‘যে আমাকে দেয়, সে কি গুনে দেয়?’
শেষ দিনগুলো
শেষ দিকে জলন্ধরে ফিরে যান সায়গল, যখন চিকিৎসকেরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরিবার তাঁকে ইচ্ছেমতো জীবন কাটাতে দেয়। মৃত্যুর আগে নিজেই মাথা কামিয়ে বলেছিলেন, মুম্বাইয়ে (তখনকার বম্বে) ফিরে সন্ন্যাসী ও ভক্তের চরিত্র করবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, ১৯৪৭ সালের ১৮ জানুয়ারি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সায়গল।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস