অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খান দুজনেই অন্তর্জালে বেশ সক্রিয়। শাহরুখ খানের রসবোধের প্রমাণ মেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া তাঁর পোস্টগুলোতে। অন্যদিকে অমিতাভ তো নিয়ম করে ব্লগও লেখেন। তবে নিয়মিত অন্তর্জালে লেখালেখির জন্য পরিচিত এই দুই তারকা নন, বলিউডে ইন্টারনেটের প্রথম ব্যবহারকারী মনে হয় হয় শাম্মি কাপুরকে।
শাম্মি কাপুর ছিলেন ভারতের প্রথম দিকের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একজন এবং বলিউডের একেবারে প্রথম। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে, সত্তরের কোঠায় থাকা এই অভিনেতা কিনে ফেলেছিলেন অ্যাপল ম্যাকিন্টশ ক্ল্যাসিক ডেস্কটপ। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ডায়াল-আপ লাইনও নেন তিনি। নিজের ‘ফিল্মি’ পারিবারিক বংশতালিকা নিয়ে তৈরি করেন একটি ওয়েবসাইট—junglee.org.in; যা এখনো সচল।
শাম্মি কাপুরকে অনেকেই ভারতের ‘ইন্টারনেট গুরু’ বলেন। কারণ, বয়স যখন পঞ্চাশের কোঠায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্টারনেট ইউজার্স কমিউনিটি অব ইন্ডিয়া’ ও ‘ইথিক্যাল হ্যাকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’ নামে দুটি সংগঠন।
junglee.org.in আসলে কাপুর পরিবারের নিজস্ব ওয়েবসাইট—যেখানে সংরক্ষিত আছে পৃথ্বীরাজ কাপুর থেকে ঋষি কাপুর পর্যন্ত পরিবারের তথ্য। নব্বইয়ের দশকের পর সাইটটি আর হালনাগাদ হয়নি; এমনকি ব্যানারের সেই পুরোনো ফন্টও রয়েছে আগের মতো। সেখানে শাম্মি কাপুরের বিরল সব ছবি, সিনেমার পোস্টারও দেখা যায়।
যদিও কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিলেন ড. শ্রীনিবাসন রামানি, যিনি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সালে ভারত ও বিদেশি সার্ভারের মধ্যে প্রথম অনলাইন সংযোগ স্থাপন করেন। তবে বলিউডের ক্ষেত্রে এই খেতাব একমাত্র শাম্মি কাপুরেরই প্রাপ্য।
শাম্মি কাপুর বহু ‘প্রথম’-এর কৃতিত্বের দাবিদার। নব্বইয়ের দশকে, যখন ভারতে অনেকেই কম্পিউটারের নামও শোনেনি, তিনি লন্ডন থেকে কিনে আনেন সফটওয়্যার। নিজের ওয়েবসাইট বানান, যা সে সময় ভারতের কয়েকজনেরই ছিল। ইয়াহু কোম্পানি মুম্বাই অফিস চালু করলে, স্বয়ং সহপ্রতিষ্ঠাতা জেরি ইয়াং তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাজতে থাকে তাঁর বিখ্যাত ‘ইয়াহু’ গান—যা ইন্টারনেটের অনেক আগে, তাঁর সিনেমা ‘জংলি’তে জনপ্রিয় হয়েছিল। জেরি ইয়াং স্বীকার করেন, শাম্মি কাপুরের সেই ‘ইয়াহু’ চিৎকার তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে।
অনেকে এখনো তাঁকে মজা করে জিজ্ঞেস করেন—ইয়াহু কোম্পানির মালিক কি তিনিই! কিন্তু তাঁর কাছে ‘ইয়াহু’ মানে ছিল প্রেমিকাকে জয় করার আনন্দের চিৎকার, যা তিনি সিনেমায় প্রাণ ঢেলে করতেন।
স্টাইলের রাজপুত্র
শাম্মি কাপুর ছিলেন ভারতের প্রথম প্রকৃত ‘সিঙ্গিং-ড্যান্সিং’ তারকা, যিনি নিজের স্বতন্ত্র স্টাইল দিয়ে দর্শক মাতিয়েছিলেন। হয়তো আরও দক্ষ অভিনেতা ছিলেন অন্যরা, কিন্তু তাঁর উদ্দাম শক্তি ও পর্দার ব্যক্তিত্বের সমকক্ষ কেউ ছিলেন না। আশা পরেখ, কল্পনা, শর্মিলা ঠাকুর—তাঁর হাত ধরেই প্রথম সুযোগ পান। শাম্মি সোজাসাপ্টা বলতেন, সেই সময়ে তাঁর ছবির বিক্রিই হতো মূলত তাঁর নামেই, তাই নতুন নায়িকাদের সঙ্গে কাজ করাই ছিল সুবিধাজনক।
তবে এই সাফল্যের আগে ছিল দীর্ঘ ব্যর্থতার অধ্যায়। একের পর এক ছবি ফ্লপ, এমনকি তিনি চা-বাগানের ম্যানেজার হওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। ঠিক তখনই এল ‘তুমসা নাহি দেখো’—যেখানে তিনি বদলে ফেললেন নিজের লুক, গোঁফ কেটে, চঞ্চল-উচ্ছল প্রেমিকের চরিত্রে, নাচ-গান-অ্যাকশনে ভরপুর এক ‘ইয়াহু’ ইমেজে। ছবিটি হিট হওয়ার পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
তারকাপরিবারের চাপ
শাম্মি কাপুর ছিলেন বলিউডের প্রথম পরিবারের সন্তান—বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুর থিয়েটার ও সিনেমার কিংবদন্তি, বড় ভাই রাজ কাপুর তখনই প্রতিষ্ঠিত নায়ক-পরিচালক। এমনকি স্ত্রী গীতা বলিও ছিলেন তাঁর চেয়ে বড় তারকা। ফলে তুলনার চাপ সব সময় ছিল, যদিও সম্পর্কের ক্ষতি হয়নি কখনো।
প্রেম
শাম্মির কাছে জীবনের একমাত্র সত্যিকারের প্রেম ছিলেন গীতা বলি। একদিন তিনি শর্ত দেন—সেই দিনই বিয়ে না করলে আর নয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মন্দিরে বিয়ে সেরে ফেলেন তাঁরা।
‘ভারতের এলভিস প্রেসলি’ নামে পরিচিত শাম্মি স্বীকার করতেন—তিনি আসলে নাচতে জানতেন না! নাচের ক্লাসও নিয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। তাঁর শক্তি ছিল তাল-লয়ের অনুভূতি, অভিব্যক্তি ও দেহভঙ্গি। হেলেনের মতো নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে জুটিবদ্ধ হলে তিনিই করতেন জটিল স্টেপ, আর শাম্মি ভর করতেন শরীরী ভাষা ও মুখভঙ্গিতে।
ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে এসে তিনি অভিনয় ছাড়লেন। অতিরিক্ত ওজন, ভাঙা হাড়, শারীরিক দুর্বলতা তাঁকে থামিয়ে দেয়। এরপর ইন্টারনেট হয়ে ওঠে তাঁর নিত্যসঙ্গী—বিশ্বের জানালা, সংযোগের মাধ্যম, আর এক নতুন আসক্তি।
শাম্মি কাপুরের গল্প প্রমাণ করে—তিনি শুধু বলিউডের প্রথম ইয়াহু মানুষ নন, বরং রুপালি পর্দা থেকে ডিজিটাল দুনিয়া—দুই যুগেরই আইকন।
২০১১ সালের ১৪ আগস্ট ৭৯ বছর বয়সে শাম্মি কাপুর মারা যান। ডিজিটাল দুনিয়ায় তাঁর অবদান আজও বলিউড এখনো স্মরণ করে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি ও ডিএনএ