মুম্বাইয়ে এক ছাত্রাবাসে থাকতেন ক্ষীণকায়, লাজুক এক তরুণ। বাড়িতে জানানো ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য মুম্বাইয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রতিদিন সকালে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে যাওয়া তরুণের আসল গন্তব্য ছিল শহরের নানা প্রান্তের অডিশন ভেন্যু। সেই তরুণের হন্যে হয়ে দৌড়ানোই আজ বলিউডের অন্যতম পরিচিত সাফল্যের গল্প। সেই ছেলেই আজকের জনপ্রিয় নায়ক কার্তিক আরিয়ান। আজ ২২ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে
কার্তিক আরিয়ানের আসল নাম কার্তিক তিওয়ারি। মুম্বাইয়ে এসে তিনি ভর্তি হন নাভি মুম্বাইয়ের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে; কিন্তু সেটি ছিল মূলত পরিবারের চোখে ধুলা দেওয়া। আসলে তিনি মন দিয়ে পড়তেন অভিনয়ের খাতা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতেন অডিশনের লাইনে। সম্পূর্ণ অচেনা পরিচালক–প্রযোজকদের কাছে বারবার কড়া নেড়েও সহজে দরজা খুলছিল না। ফিল্ম পরিবার থেকে না আসায় সুযোগ পাওয়া ছিল সবচেয়ে বড় বাধা।
তবু হাল ছাড়েননি আরিয়ান। কখনো রাত জেগে লাইন দিয়েছেন, কখনো স্টুডিওর বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। সেই অধ্যবসায়ই শেষ পর্যন্ত তাঁকে এনে দেয় প্রথম কাজ—লাভ রঞ্জনের নির্দেশনায় ‘পেয়ার কা পঞ্চনামা’ (২০১১)।
যে মনোলগে রাতারাতি পরিচিত
‘পেয়ার কা পঞ্চনামা’–তে পাঁচ মিনিটের একটি দীর্ঘ মনোলগ দিয়ে কার্তিক আলোচনায় আসেন। সম্পর্কের নানা ঝামেলা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
প্রথম ছবিই দর্শকের মনে দাগ কাটলেও বড় প্রযোজনা সংস্থাগুলো তখনো তাঁর দিকে তেমন নজর দেয়নি। পরপর দুটি ছবি—‘আকাশবাণী’, ‘কাঞ্চি’ বক্স অফিসে খুব সাড়া ফেলতে না পারায় তাঁর পথ আবার কঠিন হয়ে ওঠে। তবে তিনি থেমে যাননি। অভিনয়ের চর্চা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু
২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সনু কে টিটু কি সুইটি’ তাঁর ক্যারিয়ারে বড় বাঁক এনে দেয়। ছবিটি সুপারহিট হওয়ার পর কার্তিককে আর উপেক্ষা করা যায়নি। এটিও ছিল লাভ রঞ্জনের সিনেমা। এরপর একে একে তাঁর হাতে আসে মূলধারার ছবির প্রস্তাব। ‘লুকা চুপি’, ‘পতি পত্নী অউর ওহ’, ‘সত্যপ্রেম কি কথা’—সব কটিই বাণিজ্যিকভাবে ভালো চলে। ২০১৮ সাল থেকে তাঁর অভিনীত মুক্তি পাওয়া আটটি ছবির পাঁচটি হিট হয়—এমন ধারাবাহিকতা এখন বলিউডে বিরল।
হিন্দি সিনেমা যখন ধুঁকছিল
কোভিড–পরবর্তী সময়ে হিন্দি সিনেমা ছিল সবচেয়ে বড় সংকটে। পরপর বড় বাজেটের ছবিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছিল, দর্শক ওটিটিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার ওপর দক্ষিণ ভারতীয় ছবির সাফল্যে বলিউড হারাচ্ছিল নিজস্ব ছন্দ। বক্স অফিসে এমন সময় যাচ্ছিল, যখন ‘সুপারহিট’ তো দূরের কথা, ‘হিট’ শব্দটাই যেন ভুলে গিয়েছিল ইন্ডাস্ট্রি। হলমালিকদের মধ্যে আতঙ্ক, প্রযোজকদের মুখে উদ্বেগ, আর সবার একই কথা—‘হিন্দি সিনেমাকে বাঁচাবে কে?’
ঠিক সেই সময়েই মুক্তি পায় ‘ভুল ভুলাইয়া ২’। প্রথমদিকে অনেকেই ছবিটির সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কারণ, মূল ‘ভুল ভুলাইয়া’ ছিল অক্ষয় কুমারের জনপ্রিয় এক ক্ল্যাসিক; সেটিকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। তা ছাড়া সে সময় দর্শকের অভ্যাস বদলে গেছে—এমনটিই মনে করতেন সমালোচকেরা। হরর–কমেডির ধারাটিও বেশি দিন হিট দিচ্ছিল না। আরও বড় কারণ, কার্তিককে তখনো বড় বাজেটের ‘ব্যাংকেবল’ নায়ক হিসেবে পরীক্ষা করা হয়নি!
কিন্তু মুক্তির পর সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। ‘ভুল ভুলাইয়া ২’ শুধু হলে মানুষ টানেনি; বরং দীর্ঘদিন পর হিন্দি সিনেমার জন্য এনে দেয় উৎসবমুখর পরিবেশ। টিকিটের জন্য লম্বা লাইন, প্রেক্ষাগৃহে ভিড়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাউসফুল—এই সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন কার্তিক আরিয়ান। সিনেমাটি শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যই পায়নি; বরং সংকটে থাকা অসংখ্য প্রযোজকের কাছে নতুন আশার আলো হয়ে ওঠে।
অনেকে সেই সময়ে তাঁকে ডাকতে শুরু করেন ‘বক্স অফিস ত্রাতা’। সাফল্যের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন তিনি ‘ভুল ভুলাইয়া ৩’ সিনেমায়ও। সিকুয়েলের সাফল্য সাধারণত কঠিন। কারণ, দর্শকের প্রত্যাশা বেশি থাকে। কিন্তু কার্তিক দ্বিতীয় কিস্তির জনপ্রিয়তাকে ধরে রেখে নতুন কিস্তিকেও বাণিজ্যিক সাফল্যে পরিণত করেন। ‘ভুল ভুলাইয়া ৩’-এর ব্যবসা প্রমাণ করে কার্তিক এখন আর শুধু রোমান্টিক নায়ক নন; বরং তিনি আজ বলিউডের অন্যতম নিরাপদ, লাভজনক ও দর্শকনির্ভর তারকা। হিন্দি সিনেমার কঠিন সময়ে যেভাবে তিনি বক্স অফিসকে চাঙা করেছেন, তাই তাঁকে আজকের শিল্পে ‘বিশ্বাসযোগ্য নায়ক’–এর মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে।
রোমান্টিক ইমেজ ভাঙার লড়াই
রোমান্টিক নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া অনেক অভিনেতাই নিরাপদ পথেই হাঁটেন। কিন্তু কার্তিক আরিয়ান এ পরিচয়ের ভেতর আটকে থাকতে চাননি। ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময়েই তিনি বুঝে যান, শুধু ‘চকলেট বয়’ ইমেজ ধরে রাখলে বলিউডে দীর্ঘ দৌড় সম্ভব নয়। তাই ঝুঁকি নিয়েছেন, চরিত্র বেছে নিয়েছেন নিজের আরামের জায়গা ভেঙে।
তাঁর প্রথম বড় পরীক্ষা ছিল ‘ফ্রেডি’। এ ছবিতে কার্তিকের চরিত্র একজন অন্তর্মুখী, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ডেন্টিস্ট—যাঁর ব্যক্তিজীবনে লুকিয়ে থাকে ভয়ংকর অন্ধকার। এ ধরনের সাইকোলজিক্যাল চরিত্র বলিউডে খুব কমই করা হয়, আর কার্তিকের মতো মূলধারার নায়কদের জন্য তো আরও কম। ‘ফ্রেডি’তে তাঁর অভিনয় ছিল অসহায়ত্ব, ক্ষোভ ও নীরব নিষ্ঠুরতার মিশ্রণ, যা দর্শককে চমকে দেয়।
এরপর আসে ‘ধামাকা’—এক বসায় শুট করা থ্রিলার। টানা শুটিং, ক্লোজআপনির্ভর ক্যামেরা এবং পুরো ছবিতে এক চরিত্রের মানসিক চাপ ধরে রাখা—এসবই ছিল তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সিনেমায় তিনি দেখান, আবেগের ওঠানামা, ভয় ও বিভ্রান্তিকে কীভাবে সংযত অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায়।
সবশেষে আসে ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’, যেখানে তিনি অভিনয় করেন ভারতীয় অ্যাথলেট মুরলিকান্ত পান্ডের চরিত্রে। বায়োপিক মানেই তীব্র শারীরিক শ্রম—ওজন কমানো–বাড়ানো, ক্রীড়া প্রশিক্ষণ, সময়নিষ্ঠ অভ্যাস। কার্তিক এ ছবির জন্য দীর্ঘদিন কুস্তি, দৌড়, ডায়েট, এমনকি পেশাদার ক্রীড়াবিদদের মতো কোচিং নিয়েছেন। পরিচালক কবির খান তাঁর ওপর ভরসা করেই ছবিটি বানান। এটিও ছিল তাঁর জন্য বড় স্বীকৃতি।
সমালোচকদের ভাষ্যে, ‘কার্তিক হয়তো ক্ল্যাসিক অর্থে অসাধারণ অভিনেতা নন, কিন্তু তাঁর নিবেদন, প্রস্তুতি আর কঠোর পরিশ্রম তাঁকে আলাদা করে।’ তাঁরা মনে করেন, কার্তিককে ‘ফাঁকিবাজ’ মনে হয় না; বরং প্রতিটি চরিত্রে নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দেওয়া একজন সিরিয়াস অভিনেতাকে দেখা যায়।
এভাবেই রোমান্টিক ইমেজ ভেঙে নিজের অভিনয়জগৎকে প্রসারিত করেছেন তিনি। এ কারণেই কার্তিক আজ বহুমুখী, প্রাসঙ্গিক এবং বয়সে তরুণ হলেও বলিউডে দীর্ঘ ক্যারিয়ারের সম্ভাবনাময় নায়ক হিসেবে বিবেচিত।
সংযত ব্যক্তিজীবন, ক্লিন ইমেজ
বলিউডে তারকাদের নিয়ে গুঞ্জন, সম্পর্ক, বিতর্ক—এসব যেন শিল্পের নিয়মের অংশ। কিন্তু কার্তিক আরিয়ান এ নিয়মের বাইরে হাঁটেন। তাঁকে ঘিরে খুব কমই বিতর্ক শোনা যায়। সারা আলী খানের সঙ্গে তাঁর প্রেমের গুঞ্জন একসময় শিরোনাম হয়েছিল ঠিকই, তবে সেটি ছিল ক্ষণস্থায়ী। সম্পর্ক কিংবা ব্যক্তিজীবন নিয়ে বাড়তি হইচই করেন না তিনি। খুব বেশি সাক্ষাৎকারে মুখ দেখান না, মিডিয়ার সামনে নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রাখেন। এ সংযম নিজেকে ‘ওভার এক্সপোজ’ না করার অভ্যাস, আর ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি সতর্কতা—এসব মিলেই তাঁকে দিয়েছে এক বিশেষ ‘ক্লিন ইমেজ’। আর বলিউডে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এমন অভাবের সময়ে এ ইমেজই তাঁর জনপ্রিয়তার বড় ভিত্তি।
এই জনপ্রিয়তা সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে ব্র্যান্ড জগতেও। বর্তমানে যেসব বলিউড তারকাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু সবচেয়ে বেশি, কার্তিক তাঁদেরই একজন। সুপারড্রি, ক্যাডবেরি সিল্ক, ম্যাকডোনাল্ডস, বোয়াট, আরমানি এক্সচেঞ্জসহ দেশ–বিদেশের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো তাঁর মুখ বেছে নিয়েছে। প্রতিটি ব্র্যান্ডের জন্য তাঁর পারিশ্রমিক তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা—বলিউডের তরুণ অভিনেতাদের জন্য যা বিরল এক উচ্চতা।
শুধু ব্র্যান্ড নয়, রিয়েল এস্টেটেও তিনি দেখিয়েছেন বিচক্ষণতা। ২০২৩ সালে জুহুর মর্যাদাপূর্ণ এলাকায় তিনি কিনেছেন সাড়ে ১৭ কোটি টাকার একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। সম্প্রতি সেটি তিনি মাসে সাড়ে চার লাখ টাকায় লিজ দিয়েছেন, যা তাঁর আয়ের আরেকটি স্থায়ী উৎস। বক্স অফিসেও তাঁর বাজারদর বাড়ছে দ্রুত। ‘ভুল ভুলাইয়া ২’-এ যেখানে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ১৫ কোটি টাকা, সেখানে ‘ভুল ভুলাইয়া ৩’-এ গিয়ে সেই পারিশ্রমিক বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকায়।
সব মিলিয়ে আজ তাঁর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি রুপি। পরিশ্রম, হিসেবি সিদ্ধান্ত এবং নির্লিপ্ত ব্যক্তিজীবনের সংমিশ্রণে তিনি হয়ে উঠেছেন বলিউডের সবচেয়ে ব্যাংকেবল তরুণ তারকাদের একজন। বাড়িতে মিথ্যা বলে অভিনয়ের জন্য মুম্বাইয়ে ফেরা সেই ছেলে আজ বলিউডে আত্মবিশ্বাস, স্থিরতা ও বাণিজ্যিক সাফল্যের অন্যতম প্রতীক—এটিই তাঁর গল্পের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী অংশ।