চলতি বছর ঢালিউডে মূল চরিত্রের নায়ক-নায়িকাদের ঝলমলে উপস্থিতির বাইরে সবচেয়ে আলোচনায় ছিলেন পার্শ্বচরিত্রের অভিনয়শিল্পীরাও। গল্পের ভেতর যাঁরা নীরবে-নিভৃতে কখনো বন্ধু, কখনো প্রেমিক–প্রেমিকা, কখনো সহকর্মী বা পরিবারের সাধারণ সদস্য হয়ে আলো কেড়েছেন। ব্যাপ্তি কমবেশি হলেও তাঁরা পর্দায় নিজেদের সেরা অভিনয় দিয়ে আলোচনায় ছিলেন। বছরের আলোচিত ১০ পার্শ্বচরিত্র নিয়েই এ আয়োজন।
১. ফজলুর রহমান বাবু (‘ইনসাফ’)
পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসেবে আলোচিত ফজলুর রহমান বাবু। বছরজুড়েই তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। এর মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছেন ‘ইনসাফ’ সিনেমায় সৎ পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকায় অভিনয় করে। তিনি ছিলেন গল্পের নায়ক শরীফুল রাজের বাবা। ছেলে অপরাধে যুক্ত হলে সততার কারণে তিনি ছেলের কাছ থেকে দূরে চলে যান। এই চরিত্রের অসহায়ত্ব, সন্তানের জন্য আকুতি ছুঁয়ে গেছে দর্শকদের। বাবা-ছেলের সম্পর্কটি বাস্তবসম্মতভাবে ফুটিয়ে তোলার কারণে চরিত্রটি দর্শকদের মনে গেঁথে যায়।
২. রোকেয়া প্রাচী (‘সাবা’)
শিরিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী। দীর্ঘদিন ধরে মেয়ে সাবার ওপর নির্ভরশীল। এই শিরিনের নিজের জীবন নিয়ে আর কোনো ভাবনা নেই, একমাত্র মেয়েকে নিয়েই যত চিন্তা। জীবনের নানা অসহায়ত্ব ও শারীরিক সীমাবদ্ধতার দিকটি খুব মর্মস্পর্শীভাবে দেখানো হয়েছে এ সিনেমায়। শিরিন চরিত্র দিয়ে আলোচনায় এসেছেন রোকেয়া প্রাচী। সিনেমায় তাঁর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মেহজাবীন চৌধুরী। অনেক দৃশ্যে সংলাপের চেয়ে তাঁর নীরবতা ও অভিব্যক্তিই বেশি কথা বলেছে, যা চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্যতা ও গভীরতা দিয়েছে।
৩. ইরেশ যাকের (‘বাড়ির নাম শাহানা’)
১৯৯০-এর দশকের গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত সিনেমাটি চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে অস্কারে পাঠানো হয়েছে। গল্পে একজন বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীর নিজের মতো করে বাঁচার অদম্য সংগ্রাম দেখানো হয়েছে। সেই গল্পে ব্যতিক্রম চরিত্র ছিল সুখময় হালদার। চরিত্রটি ছিল সিনেমার মূল চরিত্র দীপাকে প্রেরণা জোগানোর। যা যথাযথভাবে করতে পেরেছেন ইরেশ। সুখময়ের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর নতুন করে সে জীবন নিয়ে ভাবতে থাকে। মনে একসময় ভালোবাসা দোলা দেয়। কিন্তু সে কথা অব্যক্তই থেকে যায়। বরং সে দীপাদের বিপদ-আপদে সব সময়ই হাজির থাকে, দীপার মা তাকে অত্যধিক স্নেহ করেন। চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের টানাপোড়েন ভিন্ন একটা মাত্রা যোগ করে। তাঁর চরিত্রের সাবলীল অভিনয়, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দারুণ ফুটে ওঠে, যা সিনেমায় একটা রেশ রেখে যায়।
৪. ইন্তেখাব দিনার (‘বরবাদ’)
চরিত্র পছন্দ হলেই দ্বিতীয় কোনো কথা নেই। চরিত্রের দৈর্ঘ্য নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলেন না। পার্শ্বচরিত্রগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে একের পর এক নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন ইন্তেখাব দিনার। চলতি বছর প্রথমবারের মতো তাঁকে দেখা যায় শাকিব খানের সঙ্গে পর্দা ভাগাভাগি করতে। তাঁর চরিত্রের নাম ছিল শিহাব। শাকিব খানের মামার চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। চরিত্রে সাধারণ থেকে হঠাৎ ‘অন্য রকম’ হয়ে ওঠেন। শেষে দর্শকদের চমকে দেয় শিহাব। চরিত্রটি সিনেমাকে আরও বেশি গতি এনে দেয়। এই সিনেমা ছাড়াও চলতি বছর ‘উৎসব’, ‘চক্কর ৩০২’ সিনেমাগুলো দিয়েও নজর কেড়েছেন এই অভিনেতা।
৫. সুনেরাহ্ বিনতে কামাল (‘দাগি’, ‘উৎসব’)
প্রথম সিনেমায় অভিনয় করে নায়িকা হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেই সুনেরাহ বিনতে কামালকে এবার ‘দাগি’ ও ‘উৎসব’-এ দেখা গেছে পার্শ্বচরিত্রে। শিহাব শাহীনের দাগি-তে লিখন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যে মেয়েটি কথা বলতে পারে না। তার সঙ্গে ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় নিশানের (আফরান নিশো)। ক্ষণিকের জন্য তাদের ভালোবাসা দর্শকদের চোখে আরাম দেয়। উৎসব সিনেমায় মাত্র দুটি দৃশ্যে অভিনয় করেও নিজের ছাপ রেখেছেন।
৬. শাশ্বত দত্ত (‘চক্কর ৩০২’)
মোশাররফ করিমের মতো অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করার চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছেন তরুণ অভিনেতা শাশ্বত দত্ত। এটি ছিল তাঁর মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা। দুজনই সিনেমায় গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মোশাররফের সঙ্গে তাঁর সহকারী সজীব চরিত্রে শাশ্বত দত্তর রসায়নও জমজমাট ছিল। প্রথম সিনেমাতেই উজ্জ্বল এই তরুণ অভিনেতা। তাঁর অভিনয়, অভিব্যক্তি চরিত্রটিকে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য করেছে।
৭. রাজীব সালেহীন (‘দাগি’)
‘দাগি’ সিনেমায় অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন রাজীব সালেহীন। তাঁর চরিত্রের নাম ছিল বাবু। পরিচালক শিহাব শাহীন ও অভিনেতা আফরান নিশো চরিত্র তৈরিতে তাঁকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন। সহশিল্পী নিশোর কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছেন। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে আলাদা গুরুত্ব তাঁর দায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ চরিত্রভাবনা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। রাজীব জানিয়েছেন, চরিত্রে কী কী ইনপুট দেওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করেন পরিচালক ও নিশো। সব মিলিয়ে মফস্সলের তরুণের চরিত্রে দারুণভাবে মানিয়ে গেছেন তিনি।
৮. পূজা ক্রুজ (‘এশা মার্ডার: কর্মফল’)
শৈশব থেকেই সিনেমার নায়িকা হওয়ার ইচ্ছা ছিল। যে কারণে শৈশব থেকেই নাচ–গান দিয়ে সেই প্রস্তুতির শুরু। স্কুল–কলেজে নাচ মানেই পূজা থাকবেন। সেখানেও তাঁর ভক্ত জুটে যায়। দামাল সিনেমায় ছোট একটি চরিত্রে সুযোগ পান পূজা ক্রুজ। এরপর চলতি বছর এল এশা মার্ডার। সিনেমায় দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র ছিল এটি। তাঁর খুন ঘিরেই রহস্য। পুরো গল্পে তাঁকে দেখা যায় ফ্ল্যাশব্যাকে। মফস্সলের এক তরুণীকে কত বাধাবিপত্তি পার করে আসতে হয়, সেটা অভিনয় আর অভিব্যক্তি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
৯. ফারজানা বুশরা (‘চক্কর ৩০২’)
সিনেমার শুরুটা হয় লিমাকে (ফারজানা বুশরা) দিয়েই। বন্ধুদের সঙ্গে মজা করছেন একটা গ্ল্যামারাস মেয়ে। তবে দ্রুতই খুনের দায়ে অভিযুক্ত হন লিমা। তখন দেখা যায় তাঁর ভিন্ন রূপ। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর যখন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন, তখন তিনি ভেঙে পড়েন। দুই দৃশ্যে লুক বদলের সঙ্গে সঙ্গে শরীরী ভাষা, কথা বলার ঢং—সবই আলাদা। তবে দুটি দৃশ্যেই বেশ ভালোভাবে উতরে গেছেন বুশরা। সিনেমাটিতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগপর্যন্ত কাঁপছিলেন বুশরা—মোশাররফ করিমের মতো বড় মাপের একজন অভিনেতার সামনে নিজেকে ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারবেন তো? পরে মোশাররফ করিমই তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন।
১০. জাকির হোসেন (‘দেলুপি’)
সিনেমায় অভিনয় করবেন বলে দেশ ছেড়ে একসময় ভারতে গিয়েছিলেন। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিছু কাজের সুযোগ পেলেও সিনেমার অভিনেতা হওয়া হয়নি জাকির হোসেনের। এসবই যেন তাঁর কাছে স্মৃতি। ধরেই নিয়েছিলেন, আর কখনো হয়তো অভিনেতা হওয়া হবেই না। সেই জাকিরই মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের ‘দেলুপি’তে জাকির চেয়ারম্যান চরিত্রে নজর কেড়েছেন। স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। মুক্তির পর তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলাদাভাবে আলোচনা হয়েছে।