‘দেলুপি’র দৃশ্য। নির্মাতার সৌজন্যে
‘দেলুপি’র দৃশ্য। নির্মাতার সৌজন্যে

একসময় দর্শক আবিষ্কার করেন, দেলুপি আসলে বাংলাদেশ

ঘটনার শুরু খুলনার পাইকগাছা উপজেলার একটি ইউনিয়নে।নাম দেলুপি। যাত্রাপালার মহড়া চলছিল গ্রামের একটি বাড়িতে। মথুরার মহারাজা উগ্রসেনের রাজ্যে মহা দুর্বিপাক। তার ছেলে যুবরাজ কংসের অত্যাচারে দেশবাসী বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে যাত্রাপালার এক অভিনেতার মুঠোফোন বেজে ওঠে। খবর আসে প্রধানমন্ত্রী ‘সাবিনা’ পালিয়ে গেছেন।

 মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের ‘দেলুপি’ সিনেমার গল্প ঠিক এখান থেকে শুরু। একটা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। আর তার প্রায় কাছাকাছি সময়ে দেখা দেওয়া আকস্মিক বন্যায় দেলুপির মানুষ হতভম্ব। শুরু হয় নতুন করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আর প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক, এই দুই দুর্যোগ যেভাবে দেলুপির মানুষজন মোকাবিলা করে, সে গল্প নিয়েই এই চলচ্চিত্র।

সিনেমা দেখতে দেখতে একসময় দর্শক আবিষ্কার করেন, দেলুপি আসলে বাংলাদেশ। যে ঘটনাপ্রবাহ দেলুপির কৃষক, জেলে, যাত্রাপালা দলের সদস্য, রাজনীতিবিদ, তরুণদের ছুঁয়ে এগিয়ে চলে, তা পুরো দেশেরই কাহিনি।

‘দেলুপি’ সিনেমার দৃশ্য

দেবেশ রায় তাঁর ‘উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে’ বইয়ে অভিযোগ করেছিলেন, এ দেশের লেখকেরা পাশ্চাত্য গদ্যরীতিতে ভর করে, তাঁদের মননে উপন্যাসের কাঠামো নির্মাণ করেছেন। বাংলার পুঁথি, পালা বা গীতিকার ধারা থেকে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদি সে ধারায় বাংলা উপন্যাস এগিয়ে যেত তবে নিশ্চয় ভিন্ন কিছু পেতাম আমরা।

চলচ্চিত্র মাধ্যমের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা খাটে। এ দেশের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রে আমরা তেমন স্বতন্ত্র দেশীয় ভাষা খুঁজে পাই না। সেটা যে থাকতে হবে, তা–ও নয়। কিন্তু ‘দেলুপি’ যেন সেই চেষ্টা করেছে। সেদিক দিয়ে ‘দেলুপি’ বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটা ঘটনাও হয়ে থাকল।

যাত্রাপালার নাটকীয়তাকে ধরে নতুন নির্মাণের পথে এগিয়েছে এই চলচ্চিত্র। একই সঙ্গে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতা থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেনি। লম্বা বেড়িবাঁধ ধরে যাত্রাপালার অভিনেতাদের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় ইংমার বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’–এর দৃশ্যকে। অথবা ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ও যেন উঠে আসে মিহিরকে বলা পলাশের সংলাপে।

পলাশ যেন বিজন ভট্টাচার্যের কণ্ঠেই মিহিরকে বলতে থাকে, ‘তুই চলে যা।’ দুঃখকে মেনে নেওয়া বাঙালির নিয়তি, ট্র্যাজেডিকে বরণ করে নেওয়াই তার পরমার্থ—এই সংলাপে সেই মনোভাবকে যেন ঠাট্টা করা হলো। কিন্তু তরুণ মিহির এই অমোঘ সত্যকে বদলে দিল।

‘দেলুপি’ সিনেমার দৃশ্য

‘দেলুপি’তে কোনো ভিলেন নেই। কোনো বিদ্বেষ নেই। আছে বিশ্বাস, আছে প্রেম। নতুন কিছু হবে, সেই স্বপ্নের বীজ। যারা বাংলাদেশের বড় পরিবর্তনের দিকে তাকিয়ে আবার আশাহত হয়েছেন, ‘দেলুপি’ তাদের শুশ্রূষা দেবে। এই চলচ্চিত্র আশাবাদের চলচ্চিত্র। সেই আশাবাদ কোনো রাজনৈতিক প্রত্যয় থেকে আসেনি। এসেছে এ দেশের মানুষের প্রতি বিশ্বাস থেকে।

চট্টগ্রামে আমি যখন প্রেক্ষাগৃহে বসে সিনেমাটি দেখছিলাম, তখন দর্শকদের ক্ষণে ক্ষণে হেসে উঠতে, হাততালি দিতে শুনেছি। বিশেষ করে যখন একদিকে কংসের বধ হচ্ছে আর অন্যদিকে একটি যুগলের প্রেম পরিণতি পাচ্ছে। অশুভের পতন আর প্রেমের জয়, এর বাইরে মানুষ আর কী চাইতে পারে। এক দর্শক তো বলে ফেললেন, ‘দেলুপি’ না দেখাটা রীতিমতো অন্যায়।