‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স
‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স

অ্যাকশন ছাড়া আর কী আছে

‘একটি খুন তোমার তিন গুণ ধৈর্যশক্তি বাঁচায়’, যাঁরা জনপ্রিয় অ্যাকশন-রিভেঞ্জ সিনেমা ‘কিল বকসুন’ দেখেছেন, তাঁদের সংলাপটি মনে থাকার কথা। এই সংলাপ দিয়েই ‘খুনিদের জগৎ’ সম্পর্কে ধারণা দিতে পেরেছিলেন পরিচালক। ২০২৩ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সিনেমাটি। তবে অনেকের মতে, বাউন সাং-হিউন পরিচালিত এ সিনেমা ‘জন উইক’ ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত। সিনেমার অ্যাকশন, হ্যান্ড টু হ্যান্ড লড়াই থেকে ক্যামেরার ছুটে চলায় কিয়ানু রিভসের সিনেমাগুলোর কথা মনে পড়ে ভালোভাবেই। যদিও ‘কিল বকসুন’ সিনেমায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে সম্পর্কের দিক, তবে খুনিদের গোপন সমাজ ও নিয়মের অনেকটাই জন উইকের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

একনজরেসিনেমা: ‘ম্যান্টিস’পরিচালক: লি তায়ে-সাংঅভিনয়: ইম সি-ওয়ান, পার্ক গিউ-ইয়ং, জো উ-জিন, চোই হিউন-উকলেখক: বিউন সাং-হিউন, লি তায়ে-সাং, লি জি-সিওনস্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্সধরন: অ্যাকশন থ্রিলারদৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট

নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ‘কিল বকসুন’-এর  স্পিন–অফ সিনেমা ‘ম্যান্টিস’। অক্টোবরের ২ তারিখে মুক্তি পেয়েছে সিনেমাটি। নেটফ্লিক্সের ইংরেজিবিহীন ভাষার সিনেমার তালিকায় শীর্ষ–৫–এ রয়েছে সিনেমাটি। কোরীয় নির্মাতা বাউন সাং-হিউনের ‘খুনিদের দুনিয়া’র নতুন সংযোগ এই সিনেমা। তবে সাং-হিউন ‘ম্যান্টিস’ পরিচালনা করেননি, আছেন সহলেখক হিসেবে। ‘ম্যান্টিস’ পরিচালনা করেছেন লি তায়ে-সাং।

গল্প যেহেতু পেশাদার খুনিদের নিয়ে, তাই শুরুতেই চমক দেখান পরিচালক। ঠান্ডা মাথায় হতে থাকে একের পর এক খুন। নিজের দক্ষতা দেখিয়ে খুন করতে থাকেন হান-উল (ইম সি-ওয়ান) নামের এক তরুণ, যিনি ম্যান্টিস নামেও পরিচিত। এরপর তাঁর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় এমকে এন্টারটেইনমেন্টের প্রধান নির্বাহী চা মিন-কিওকে (সোল কিউং-গু)।

‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স

এরপর ঘটনা এগোতে থাকে ‘কিল বকসুন’ সিনেমার পরবর্তী সময় থেকে। প্রেসিডেন্ট চা-এর মৃত্যুর পর ভেঙে পড়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা এমকে এন্টারটেইনমেন্ট। এ শূন্যতা সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা। বাজারের তরুণ খুনিরা নিজেদের জায়গা তৈরি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
তবে আত্মবিশ্বাসী ম্যান্টিস ভাবেন কাজ পাওয়ার জন্য তাঁর নামই যথেষ্ট; কিন্তু তাঁর শৈশবের বন্ধু ও পছন্দের মানুষ শিন জে-ইয়ের (পার্ক গিউ-ইয়ং) সঙ্গে  আগের ঘটনার জেরে কাহিনি দ্রুত অন্যদিকে মোড় নিতে থাকে। দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিশ্বাসঘাতকতা আর নিজেকে খোঁজার লড়াই চলতে থাকে ম্যান্টিসের। অন্যদিকে জে-ইর পাশে থাকতে গিয়ে বেরিয়ে আসে একের পর এক কঠিন সত্য। শেষ পর্যন্ত কী হয় জানতে হলে দেখতে হবে সিনেমাটি।

‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স

‘ম্যান্টিস’ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইম শি-ওয়ান। তিনি এত ভালো অভিনয় করেছেন যে এটি তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ বলাই যায়।

কখনো মনে হয়েছে ‘ম্যান্টিস’ যেন ‘কিল বকসুন’-এর একটি ‘বর্ধিত সংস্করণ’ মাত্র, স্বতন্ত্র কোনো সিনেমা নয়। নতুন প্রজন্মের যে অস্থিরতা দেখানো হয়েছে, এই অস্থিরতাই যেন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সিনেমায়। ‘কিল বকসুন’-এর মতো একজনের যাত্রার গল্প নয়; বরং ‘ম্যান্টিস’ একসঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে টানাটানি করে। বেকারত্ব, কোম্পানির রাজনীতি, অপ্রয়োজনীয় সাইড প্লট—সব মিলিয়ে গল্পটা জটিল হয়ে যায়।

আত্মবিশ্বাসী কিন্তু অস্থির  ‘অ্যান্টি-হিরো’ হান-উলের চরিত্রে তিনি মানিয়েছেন ভালো।
জে-ই চরিত্রে পার্ক গিউ-ইয়ংও দারুণ। হারিয়ে যেতে যেতে তিনি নিজের জায়গা করে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ক্ষোভ ও অপূর্ণতায় তিনি যখন ফেটে পড়েন, তখন তিনি ছাড়িয়ে গেছেন হান-উলকেও। আবার সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে গিয়ে তাঁর চারিত্রি্৵ক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনও ছিল আবেগপূর্ণ। ইম শি-ওয়ান ও পার্ক গিউ-ইয়ংয়ের রসায়ন এ ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। প্রশিক্ষণের স্মৃতি, প্রতিযোগিতা ও প্রেম তাঁদের সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে।

পুরোনো মেন্টর ডকগো হিসেবে ছিলেন জো উ-জিন। হাস্যরসাত্মক কঠিন অ্যাকশন দৃশ্যগুলো তিনি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে চোই হিউন-উক অভিনীত বেনজামিন চরিত্রটি এ সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল দিক ছিল। তাঁর উপস্থিতি গল্পে কিছুটা রোমাঞ্চ নিয়ে এলেও খুব একটা অবদান রাখতে পারেনি।

‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স

‘কিল বকসুন’ সিনেমায় নির্মাতা এক অভিজ্ঞ ঘাতকের গল্প বলেছিলেন। অন্যদিকে ‘ম্যান্টিস’ পুরোটাই নতুন প্রজন্মের কথা ভেবে বানানো। ভেঙে যাওয়া এক সিস্টেমের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন দুই তরুণ-তরুণী, যাঁরা নিজেদের জায়গা করে নিতে মরিয়া। কাজ কম, প্রতিযোগী বেশি, বেঁচে থাকা কঠিন—সিনেমার এ দিকটা আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়। যদিও এ দিকটি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি নির্মাতা। ‘কিল বকসুন’-এর মতো মা-মেয়ের আবেগ এখানে নেই; বরং এটিকে বলা যায় ছুরি-কাঁচির লড়াইয়ের এক স্টার্টআপের প্রতিযোগিতা।

‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স

অ্যাকশন দৃশ্যগুলো এ সিনেমার বড় শক্তি। লি তায়ে-সাংয়ের অ্যাকশন পরিচালনা নিখুঁত। অপ্রয়োজনীয় রক্তপাত নেই; প্রতিটি লড়াই গল্পের অংশ। অস্ত্রসহ কিংবা অস্ত্র ছাড়া; দুই ক্ষেত্রেই অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্স পর্দায় দেখতে রোমাঞ্চকর লাগে। দৃশ্যগুলোও বাস্তবসম্মত।

তবে গল্প বেশ ক্লিশে। বেশ কয়েকবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। দুই প্রধান চরিত্রের দ্বন্দ্ব আকর্ষণীয় হলেও তা গল্পে কোনো গভীরতা যোগ করে না। কখনো মনে হয়েছে ‘ম্যান্টিস’ যেন ‘কিল বকসুন’-এর একটি ‘বর্ধিত সংস্করণ’ মাত্র, স্বতন্ত্র কোনো সিনেমা নয়। নতুন প্রজন্মের যে অস্থিরতা দেখানো হয়েছে, এই অস্থিরতাই যেন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো সিনেমায়। ‘কিল বকসুন’-এর মতো একজনের যাত্রার গল্প নয়; বরং ‘ম্যান্টিস’ একসঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে টানাটানি করে। বেকারত্ব, কোম্পানির রাজনীতি, অপ্রয়োজনীয় সাইড প্লট—সব মিলিয়ে গল্পটা জটিল হয়ে যায়। বন্ধুত্ব, ঈর্ষা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার সংঘর্ষ গল্পকে এগিয়ে নেয়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনেমা এই সংঘাতকে যতটা গভীরভাবে তুলে ধরতে পারত, তা হয়নি।

‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স

সিনেমার নির্মাণশৈলী চমৎকার। অ্যাকশন সিনেমা যাঁদের পছন্দ, তারা এটি উপভোগ করবেন। হাস্যরসও রয়েছে। গল্পের গতি বেশ কিছু জায়গায় বেশ ধীর। তবে তার পরপরই রোমাঞ্চকর কিছু এনে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই শুরু করলে সিনেমাটি না দেখে ওঠা যায় না। যদিও সিনেমার শেষে বেশ কিছু প্রশ্ন রয়ে যায়। ‘ম্যান্টিস’ হলো সেই ছোট ভাই, যে বড় বোনের (কিল বকসুন) ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। সেটি অবশ্যই পারেননি; তবে কেবল অ্যাকশনের জন্যই সিনেমাটি একবার দেখা যায়।

‘ম্যান্টিস’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স