‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি
‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

ভয়াবহ দাবানল, ২২ শিশুকে কি বাঁচাতে পারবেন বাসচালক...

চলতি শতকের শুরুতে ‘বর্ন’ ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে হলিউডের অ্যাকশন সিনেমায় নতুন ভাষা দিয়েছিলেন পল গ্রিনগ্রাস। তাঁর সিনেমায় চরিত্রগুলো অনিশ্চয়তায় ভোগে, ক্যামেরার ঝাঁকুনিও তাই চলতে থাকে পর্দাজুড়ে। ছোট ছোট দৃশ্যে, অবিরাম ছুটে চলা মিলিয়ে ক্যামেরায় রোমাঞ্চ তৈরি করতে ওস্তাদ তিনি। পরের দিকে নির্মিত ‘গ্রিন জোন’ বা ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’-এও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন নির্মাতা। এবার পল গ্রিনগ্রাস হাজির দাবানলের গল্প নিয়ে। বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফেরার সিনেমা। এ ধরনের সিনেমার শেষে কী হয়, সেটা সবারই জানা; কিন্তু পরিচালক যেখানে গ্রিনগ্রাস, সেখানে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু যে থাকবেই তা বলাই বাহুল্য। হয়েছেও তাই, টান টান চিত্রনাট্য, বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় আর দুর্দান্ত নির্মাণ মিলিয়ে ‘দ্য লস্ট বাস’ হয়ে উঠেছে উপভোগ্য অভিজ্ঞতা।

‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

সেই দাবানলের গল্প
‘দ্য লস্ট বাস’ যেন আগুনের ভেতরেও আশার গল্প। ২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ভয়াবহ ‘ক্যাম্প ফায়ার’-এর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। যে অগ্নিকাণ্ডে ৮৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ১ লাখ ৫০ হাজার একরের বেশি এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

‘দ্য লস্ট বাস’ আমাদের সেই আগুনের মধ্যেই নিয়ে যায়, যেন আমরা নিজেরাই  ধোঁয়ায় ঘেরা সেই নরকযাত্রার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যেকোনো মুহূর্তে আগুনের আঁচ এসে লাগবে গায়ে। আগুনের শিখা, বাতাসের ঘূর্ণি, আর পুড়ে যাওয়া গাড়ির সারি, সবই যেন নরকের প্রতিচ্ছবি।

গ্রিনগ্রাস ও সহ-চিত্রনাট্যকার ব্র্যাড ইনগেলসবাই প্রেরণা নিয়েছেন সাংবাদিক লিজি জনসনের ২০২১ সালের বই ‘প্যারাডাইস: ওয়ান টাউনস স্ট্রাগল টু সারভাইভ অ্যান আমেরিকান ওয়াইল্ড ফায়ার’ থেকে। বইটি ক্যালিফোর্নিয়ার ‘প্যারাডাইস’ নামের একটি শহরের ভয়ংকর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলে, যেখানে এক স্কুলবাস চালক কেভিন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়েছিলেন একদল শিশু ও তাঁদের শিক্ষিকাকে।

আগুনের ভেতর মানবিকতার গল্প
ছবিতে কেভিনের ভূমিকায় ম্যাথু ম্যাকনাহে—একজন সাধারণ, ঘামে ভেজা, ক্লান্ত মানুষ, যিনি পরিস্থিতির চাপে হয়ে ওঠেন নায়ক। শিক্ষিকা মেরি লুডউইগ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমেরিকা ফেরেরা—একজন যত্নশীল, কিছুটা কঠোর স্বভাবের নারী। তাঁদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক আবেগঘন বন্ধনে; অনেকটা ‘দ্য আফ্রিকান কুইন’-এ ক্যাথারিন হেপবার্ন ও হামফ্রে বোগার্টের মতোই।

‘দ্য লস্ট বাস’–এর পোস্টার। আইএমডিবি

আগুনের আগে কেভিন ছিলেন সব অর্থেই মানুষ। ছেলে ও প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত, স্কুলবাস চালকের চাকরিটিও প্রায় হাতছাড়া হওয়ার পথে। বয়স্ক মা গুরুতর অসুস্থ, প্রচুর দেনার দায়ে টালমাটাল কেভিন। কিন্তু ঠিক এমন সময়ই আগুন লাগে, আর সেই বিপর্যয়ের মধ্যেই শুরু হয় তাঁর মুক্তির গল্প। ছবিতে ম্যাথু ম্যাকনাহের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করা লেভি ম্যাকনাহে বাস্তব জীবনেও তাঁর সন্তান; যা বাবা-ছেলের আবেগকে আরও মর্মস্পর্শী করে তুলেছে।

আগুনের চোখ দিয়ে দেখা বিপর্যয়
গ্রিনগ্রাসের ক্যামেরা যেন নিজেই আগুনের শিখা—এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে চলে, ঝলসে দেয় পর্দা। বিদ্যুৎবাহী একটি ত্রুটিপূর্ণ তার থেকে শুরু হয় এই ভয়াবহ আগুন। আগুন ছড়িয়ে পড়তেই স্কুলে শিশুদের সরিয়ে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। অন্য কোনো যান না থাকায় কেভিন নিজেই দায়িত্ব নেন। নিজের অসুস্থ সন্তানের খোঁজে যাওয়ার কথা থাকলেও, তিনি পিছু হটেন না।

‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

বাস যখন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, তীব্র তাপে প্রায় জ্বলতে বসেছে, তখন শিশুরা জ্ঞান হারাতে শুরু করে। মেরি প্রায় হাল ছেড়ে দেন—‘এভাবে মারা যাওয়ার চেয়ে ঘুমিয়ে পড়াই কি ভালো নয়?’ কেভিন দৃঢ় গলায় বলেন, ‘এভাবে কথা বলো না।’

এদিকে ফায়ার ডিপার্টমেন্টের সদর দপ্তরে আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা। কর্মকর্তারা চিৎকার করে বলছেন, ‘সবাই শোনো…।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা, পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। গ্রিনগ্রাসের নির্মাণ এতটাই বাস্তব যে খবরের ভিডিও ফুটেজও যেন নিস্তেজ মনে হয়। আগুনের ভয়াবহতার যে শব্দ, উত্তাপ আর আতঙ্ক আমরা শুধু সংবাদচিত্রে দেখি, ‘দ্য লস্ট বাস’ আমাদের সেই আগুনের মধ্যেই নিয়ে যায়, যেন আমরা নিজেরাই  ধোঁয়ায় ঘেরা সেই নরকযাত্রার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যেকোনো মুহূর্তে আগুনের আঁচ এসে লাগবে গায়ে। আগুনের শিখা, বাতাসের ঘূর্ণি, আর পুড়ে যাওয়া গাড়ির সারি, সবই যেন নরকের প্রতিচ্ছবি।

‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

ছবির চিত্রগ্রাহক পল উলভিক রকসেথের সঙ্গে এটি গ্রিনগ্রাসের দ্বিতীয় কাজ। তাঁদের আগের ছবির মতোই ক্যামেরা কাঁপে, ঘুরে বেড়ায়। কারও কারও হয়তো মাথা ঘুরে যাবে, কিন্তু এই কাঁপুনি থেকেই তৈরি হয় বাস্তবের তীব্রতা।

উত্তেজনা কমে না
বাস্তব ঘটনা থেকে নির্মিত বলে দর্শকেরা শুরুতেই বুঝে যান, সবাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাবে। কিন্তু তারপরও এই ছবির উত্তেজনা একটুও কমে না। গাছের জ্বলন্ত ডাল পড়ে বাসের সামনে, আকাশ ধোঁয়ায় অন্ধকার—দিন যেন রাত। দ্য লস্ট বাস প্রমাণ করে, কীভাবে একটি নাটকীয় গল্প পরিচিত ঘটনার মধ্যেও নতুন আলো ফেলতে পারে।
চলচ্চিত্রে চরিত্রগুলোর নামও বাস্তব জীবনের মতোই রাখা হয়েছে। কেভিনকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে বাস চালাতে হয়—যেখানে কখনো ধোঁয়া এত ঘন, সামনে কিছুই দেখা যায় না। ফোন ও রেডিও দুটোই বন্ধ, বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কেভিন ও মেরি একাই বাঁচিয়ে রাখতে হবে নিজেদের ও শিশুদের।

‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

সিনেমায় ২২ স্কুলশিক্ষার্থী আছে। কিন্তু নির্মাতা তাদের অসহায়ত্ব, চিৎকার তুলে না ধরে বরং কেভিন ও মেরির মানসিক সংগ্রামের ওপরেই বেশি জোর দিয়েছেন। মেরি একদিকে বাচ্চাদের সান্ত্বনা দেন, অন্যদিকে নিজের আতঙ্ক গোপন করেন। ঘামে ভেজা, ধুলোমাখা চুলে তিনি কেভিনকে বলেন, ‘ভয় হচ্ছে, হয়তো নিজের ছেলেকে আর কখনো দেখব না।’

দায় কার
শেষ দৃশ্যে পর্দায় ভেসে আসে—বৈদ্যুতিক সংস্থাকে আদালত দায়ী করেছেন এই আগুনের জন্য। সেই সময়ের ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যার নাম ছবিতে উচ্চারিত হয় না, তিনি দায় দেন বিন বিভাগকে।  একপর্যায়ে ফায়ার বিভাগের প্রধান সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, ‘এমন আগুন এখন বারবার ঘটছে’—কিন্তু বাক্য শেষ করতে পারেন না, আবেগে গলা আটকে যায়। তিনি মুখে আনতে পারেন না  ‘জলবায়ু সংকট’ শব্দবন্ধ। ছবির দুর্বলতাও এটি। কারণ ‘দ্য লস্ট বাস’ জলবায়ুসংকটের মূল বার্তাটিকে পরিপূর্ণভাবে স্পর্শ করতে পারেনি।

‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

আগুনের ভেতরেও সংযম
দুই ঘণ্টা নয় মিনিটের এই ছবির বেশির ভাগ সময়ই আমরা বাসের ভেতরে। মাঝেমধ্যে গ্রিনগ্রাস দেখান অপেক্ষমাণ মা–বাবাদের—কিন্তু সেখানে কোনো বাড়াবাড়ি আবেগ নেই, বরং সংযমই ছবির শক্তি।

একপর্যায়ে ফায়ার বিভাগের প্রধান ঘোষণা দেন, আর কোনো সম্পদ অবশিষ্ট নেই, এখন শুধু মানুষ বাঁচাতে হবে। গ্রিনগ্রাস কখনোই দর্শককে উপদেশ দেন না, বরং ভয়, তাপ ও আশার ভেতর দিয়ে অনুভব করান বাস্তবতা কতটা কঠিন। এ সিনেমাতেও তিনি সফলভাবে করতে পেরেছেন।

যেভাবে তৈরি হলো ‘দ্য লস্ট বাস’
পল গ্রিনগ্রাস সব সময়ই বাস্তব ঘটনা পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে আগ্রহী। ২০ বছর বয়স থেকে তিনি যখন তথ্যচিত্র তৈরি শুরু করেন, পরে তাঁর সিনেমাগুলোতেও পাওয়া যায় তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রভাব।
গ্রিনগ্রাস বলেন, ‘আমার কিছু সময় লেগেছিল নিজের স্টাইল খুঁজে পেতে। আমি চেয়েছি তথ্যচিত্র আর পূর্ণদৈর্ঘ্যের মধ্যে সঠিক সমন্বয় খুঁজে পেতে।’
নির্মাতার এই দর্শন থেকেই তৈরি হয়েছে ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’ ও ‘ইউনাইটেড ৯৩’-এর মতো  চলচ্চিত্র। ‘দ্য লস্ট বাস’ মুক্তির আগে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় গ্রিনগ্রাস বলেন, ‘যে প্রকল্পগুলো আমি বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র করে করি, সেগুলো সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একধরনের হয় শান্ত, সংযত—যেমন “ব্লাডি সানডে”, “ইউনাইটেড ৯৩”, বা “২২ জুলাই”। আরেকটি ধরন হয় সিনেমাটিক—যেমন “ক্যাপ্টেন ফিলিপস”। “দ্য লস্ট বাস” দ্বিতীয় ধারার।’

বাস্তব নায়কের গল্প
২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। বৈদ্যুতিক সংযোগের ত্রুটির কারণে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার বাট কাউন্টিতে শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড। সেই ঘটনা নিয়ে গ্রিনগ্রাস বলেন, ‘এই বাসের গল্প যখন আমাকে বলা হলো, আমি জানতাম কীভাবে এটি সিনেমায় রূপ দিতে হবে।’
তবে তিনি শুধু প্রক্রিয়াগত নয়, গল্পের থিমেও আকৃষ্ট হন। বন্য আগুন, পরিবেশগত বিপর্যয় এবং মানব বীরত্বের সামঞ্জস্যই মূল আকর্ষণ।

সত্য বনাম কল্পনা
কীভাবে সত্যকে সিনেমার ভাষায় রূপান্তরিত করা যায়, অথচ বাস্তবের মানুষদের সঙ্গে অন্যায় করা হয় না? এই জটিল সমন্বয় করতে অনেকে খেই হারিয়ে ফেলেন। গ্রিনগ্রাসের লক্ষ্য ছিল এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা। তিনি বলেন, ‘একটি নাটকীয় কাহিনি তৈরির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, কিন্তু সত্যের স্পন্দনও বজায় রাখা জরুরি।’

‘দ্য লস্ট বাস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

বাস্তব আগুন, নিরাপদ শুটিং
নিউ মেক্সিকোর এক পরিত্যক্ত আর্টস কলেজে পুরো সিনেমার শুটিং হয়, যেখানে রাস্তা ও বাঁকগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। বাস্তব আগুনের জন্য গ্যাস লাইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত শিখা তৈরি করা হয়।
গ্রিনগ্রাস বলেন, ‘বনের আগুনে আলোর প্রাকৃতিক অবস্থা অদ্ভুত। আমরা শুটিং করেছি ম্যাজিক আওয়ারে, যাতে সেই মায়াময় আলো তৈরি হয়।’
শিশুদের জন্য বিশেষ সতর্কতা ছিল। সব স্টান্ট ও দৃশ্য বারবার অনুশীলন করা হয়। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছিল।

আগুনকে চরিত্র হিসেবে দেখা
গ্রিনগ্রাস বলেন, ‘আমরা চাইছিলাম আগুন যেন “জস”-এর সিনেমার সেই শার্কের মতো চরিত্র হয়ে ওঠে। এতে আগুনের ভয়াবহ রূপ দর্শক বুঝতে পারবে।’ নির্মাতা মনে করেন, তাঁরা চেয়েছেন সিনেমাটি দিয়ে বিপদে পড়া মানুষের সত্যশক্তির মাত্রা তুলে ধরতে। বলতে চেয়েছেন পর্দার নায়ক বলে কিছু নেই, বিপদে এক সাধারণ মানুষই হয়ে উঠেতে পারেন অসাধারণ।
‘দ্য লস্ট বাস’ দেখা যাচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অ্যাপল টিভি প্লাসে।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, টাইম