সংগীতশিল্পী জেনস সুমন
সংগীতশিল্পী জেনস সুমন

গানের কথাই যেন জীবনের পরিণতি, চাদরে মোড়ানো জেনস সুমনের শেষযাত্রা

‘একটা চাদর হবে চাদর, যে চাদরে লুকিয়ে থাকবে মানবপ্রেমের আদর’—নিজের গাওয়া সেই গানের মতোই চাদরে লুকিয়েই শেষযাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন আলোচিত সংগীতশিল্পী জেনস সুমন। তবে এ যাত্রায় তিনি নিজে সেই চাদর পরেননি, তাঁকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই চাদর, যা পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে তাঁর নিথর দেহ।

জেনস সুমন

অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে তিনি চিরঘুমে; চারদিকে গাড়ি, রিকশা, মানুষের ব্যস্ত চলাচল। কতটাই না নিষ্ঠুর জীবন—অ্যাম্বুলেন্সের মাত্র কয়েক হাত দূরেই পাশের চায়ের দোকানে কয়েকজন তরুণ চা খাচ্ছিলেন। তাঁদের একজন গুনগুন করে গাইছিলেন, ‘একটা চাদর হবে চাদর…।’ হয়তো জানতেও পারেননি, যাঁর গান তিনি গাইছিলেন, সেই শিল্পী পাশের অ্যাম্বুলেন্সেই শুয়ে আছেন নিথর। এ-ই হয়তো শিল্পীর সত্যিকারের সার্থকতা। চলে যাওয়ার পরও গান বেঁচে থাকে।

শেষযাত্রার শুরু
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার একটু বেশি। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট থেকে মিরপুর রোড ধরে সুমনের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের আল মারকাজুলে। মোটরসাইকেলে পেছনে ছিলেন সংগীতশিল্পী ও সংগীতায়োজক ঈশা খান। সঙ্গে যন্ত্রসংগীতশিল্পী ফয়েজ পুলক এবং সুমনের এক মামাও। সেখানে মরদেহ ধোয়া ও কাফন পরানোর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। সেখান পৌঁছান যন্ত্রসংগীতশিল্পী আজমীর বাবু, গায়ক নমন। ফোনে বারবার খবর নিচ্ছিলেন শিল্পী ইথুন বাবু, যিনি প্রথম সুমনকে শ্রোতাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। কাজ শেষে মরদেহ আবার নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

হাসপাতালে আহাজারি, সিদ্ধান্তহীনতা
হাসপাতালে আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন সুমনের মা সুফিয়া খাতুন, স্ত্রী বীথি মেহেদী, দুই সন্তান, ছোট ভাই শরিফ মেহেদী ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। একমাত্র ছোট বোন খুলনা থেকে তখন ঢাকার পথে। রাত আটটা। তখনো ঠিক হয়নি কোথায় দাফন হবে। এদিকে হাসপাতালের এক কোণে একটু পরপর ভেঙে পড়ছেন মা সুফিয়া খাতুন। ১৮ বছর আগে স্বামীকে হারানোর পর এবার বড় ছেলেকে হারানো—এই ব্যথা কোনো ভাষায় ধরা যায় না। অবশেষে তাঁকে বাসায় পাঠানো হয়। কাঁদতে কাঁদতেই গাড়িতে ওঠেন তিনি। এ সময় হাসপাতালের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সে নিথর সুমন অপেক্ষা করে আছেন… যেন নীরব দর্শক।

জেনস সুমন

দাফনের জায়গা-সময় নিয়ে মতবিরোধ
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমে সুমনের মরদেহ ফরিদপুরে দাফনের কথা ওঠে। পরে সিদ্ধান্ত হয়, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের কবরস্থানে সমাহিত করা হবে। কিন্তু সমাহিত করার সময় নিয়ে বড় জটিলতা দেখা দেয়। সুমনের ভাই ও মামারা চান, ছোট বোন ঢাকায় পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা হোক, যাতে বড় ভাইকে শেষবার দেখতে পারেন। কিন্তু সুমনের স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল রাত ১০টার মধ্যেই দাফন করা হোক। পরিবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। আর সাদা কাফনে মোড়ানো সুমন অ্যাম্বুলেন্সে।


ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে জটিলতা
হাসপাতালের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সে সাদা কাফনে মোড়ানো সুমন চিরঘুমে। এদিকে তাঁর মরদেহ কখন দাফন হবে এ নিয়ে কথাবার্তা চলছে। এসব কথাবার্তার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স বদলের একটা সিদ্ধান্ত আসে। একমাত্র বোনের আসা এবং সকাল পর্যন্ত মরদেহ রাখতে হলে ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স লাগবে। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সামনে থাকা অ্যাম্বুলেন্সের চালকদের সঙ্গে কথা বলেন সুমনের অধ্যাপক মামা দেলোয়ার হোসেন (তিতুমীর কলেজ, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ)। মৃত ব্যক্তির পরিবারের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে দেরি করলেন না অ্যাম্বুলেন্সের চালক। দ্বিগুণ ভাড়া চেয়ে বসলেন। পরে আল মারকাজুলে যোগাযোগ করলে তারা ২০ থেকে ৩০ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর কথা জানায়। তখনই প্রথম চালক এসে বলেন, ‘ঠিক আছে, যা দিবেন ওদের, আমাকেও দিলেই হবে। মরা মানুষটারে আর কষ্ট দিই না।’ সুমনের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আমরা ওখানে কথা দিয়েছি, ওরাই নিয়ে যাক। কথাবার্তার একপর্যায়ে ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছায়। সুমনকে ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। এর মধ্যে শেষ হয় হাসপাতালের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলে উত্তরার খানটেক এলাকায় সুমনের বাসার উদ্দেশে।

খানটেকের বাড়িতে শেষ রাত
ফ্রিজিং গাড়িতে পাশে ছিলেন ছোট ভাই শরিফ ও যন্ত্রসংগীতশিল্পী পুলক। বাড়িতে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন ইথুন বাবু, তিনি সুমনের স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেন সকালে দাফন করাই ভালো। এভাবেই ঠিক হয় জানাজার সময়। আজ শনিবার সকাল ১০টায় উত্তরার খানটেক জামে মসজিদে প্রথম জানাজা হয়। পরে ৪ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে একই সেক্টরের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই কবরেই ২০০৭ সালে সমাহিত করা হয়েছিল সুমনের বাবা ফারুক মেহেদীকে। এবার তাঁর কবরেই সমাহিত করা হলো সুমনকে।


একনজরে সুমন
সুমনের পুরো নাম গালিব আহসান মেহেদী। বিনোদন অঙ্গনে ও তাঁর ভক্ত–শ্রোতাদের কাছে তিনি জেনস সুমন নামেই পরিচিত। জন্ম ১৯৭৯ সালে শরিয়তপুরে নানাবাড়িতে হলেও ছোটবেলা কেটেছে ধানমন্ডি ১৫ নম্বর এলাকায়। এরপর বেড়ে ওঠার সময়টায় ছিলেন ঢাকার মণিপুরিপাড়ায়। বাবা উত্তরার খানটেক এলাকায় বাড়ি বানানোর পর সুমনরা সেখানে বসবাস শুরু করেন।

‘একটা চাদর হবে’ অ্যালবামের কভার


কয়েক বছর ধরে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে যাত্রাবাড়িতে বসবাস শুরু করেন। গতকাল শুক্রবার সকালে যাত্রাবাড়ির বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর দ্রুত তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে জানতে পারেন তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। এরপর বেলা সাড়ে তিনটায় তিনি মারা যান। বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫। সুমন স্ত্রী, দুই সন্তান, মা, এক ভাই, এক বোনসহ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবাবন্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের রেখে গেছেন।

‘একটা চাদর হবে’—এই একটি গানই তাঁকে দেশের ঘরে ঘরে পরিচিত করে তোলে। ১৯৯৭ সালে তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘আশীর্বাদ’ প্রকাশের পর একের পর এক শ্রোতাপ্রিয় অ্যালবাম উপহার দেন তিনি ‘আকাশ কেঁদেছে’, ‘অতিথি’, ‘আশাবাদী’, ‘একটা চাদর হবে’, ‘আয় তোরা আয়’, ‘চেরি’সহ আরও অনেক গান। ২০০২ সালে বিটিভির একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রচারের পর সাড়া ফেলে ‘একটা চাদর হবে’ গানটি। রাতারাতি আলোচনায় চলে আসেন গানটির গায়ক জেনস সুমন। তারপর আরও কিছু গান করেছেন। এরপর দীর্ঘ বিরতি।

২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সবশেষ অ্যালবাম ‘মন চলো রূপের নগরে’। এরপর কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়লেও শ্রোতাদের মনে জায়গা ছিল অটুট। ১৬ বছরের বিরতি ভেঙে ২০২৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর গান ‘আসমান জমিন’। জি-সিরিজের ইউটিউব চ্যানেলে গানটি মুক্তি পায়।