
১৪ নভেম্বর বব ডিলান কনাসর্ট করেন লন্ডনে। নোবেলজয়ী এই গায়কের কনসার্টে মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। কনসার্ট দেখতে গিয়েছিলেন জলেরগানের শিল্পী দীপংকর রায়। ফিরে এসে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি।
সকাল ৭টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত অফিস করে তারপর গাড়ি চালিয়ে টানা ১৯৫ মাইল পাড়ি দিয়ে লিডসে পৌঁছালাম। বাইরে তখন বৃষ্টি, আর আমি ভিজে যাওয়া কোট পরে লম্বা কিউতে দাঁড়িয়ে ঢুকলাম ফার্স্ট ডাইরেক্ট অ্যারেনায়। ভেতরে ঢুকেই প্রথমে যা হলো—ফোনটা ধরে একদম লক করা পাউচে আটকে দিল। আর তারপর আলো-আঁধারি সেই পরিবেশ দেখে একমুহূর্তে মনে হলো, যেন কোনো ছোট, অন্তরঙ্গ জ্যাজ ক্লাবে চলে এসেছি।
বব ডিলানের শো কনসার্টের মতো নয়—বরং তাঁর নিজের সৃষ্টিশীল মহলের ভেতরে প্রবেশের মতো এক অভিজ্ঞতা। কোনো ঘোষণা নেই, কোনো জমকালো এন্ট্রি নেই। ডিলান শান্তভাবে মঞ্চে এসে বসে পড়লেন একটা বিশাল পিয়ানোর পেছনে, যা তাঁর মুখটাই প্রায় ঢেকে রাখছিল। পুরো শোজুড়ে তিনি যখন ইচ্ছা পিয়ানো, গিটার আর মাউথ অর্গানের মধ্যে বদলে গেছেন—প্রতিটা যন্ত্র যেন তাঁর সৃজনশীলতার আলাদা জানালা খুলে দিয়েছে।
তাঁর ব্যান্ড—দুই গিটারিস্ট (যাঁর একজন চমৎকার স্লাইড গিটার বাজালেন), ড্রামস আর বেস—মিলে একটা আরামদায়ক, গভীর রাতের মতো জ্যাম সেশনের আবহ বানিয়েছিল। সেই কোমল কিন্তু শক্ত মিউজিক্যাল ভিত্তির ওপর ভর করে ডিলান তাঁর ঢিলেঢালা অ্যারেঞ্জমেন্ট আর হঠাৎ বদলে ফেলা সুরের মধ্যে ঘুরে বেড়ালেন নিজের মতো করে।
পুরোনো হিট গানে নস্টালজিয়া তোলার বদলে তিনি মূলত গাইলেন ‘রাফ অ্যান্ড রাউডি ওয়েজ’ অ্যালবামের গান। তবে শুরুর দিকে ‘আই উইল বি ইওর বেবি টুনাইট’ আর ‘ইট ইন্ট মি, বেবি’ দিয়ে যে দুষ্টুমিভরা চমক দিলেন—তা আবার মনে করিয়ে দিল, তিনি এখনো আগের মতোই প্রত্যাশা ভাঙতে ভালোবাসেন।
তাঁর কণ্ঠ—খসখসে, ক্ষয়প্রাপ্ত—তবু এক অদ্ভুত সততায় ভরা। ব্লুজ ধাঁচের গান আর সম্পূর্ণ ফোনমুক্ত নীরব একটা হলের সঙ্গে সেই কণ্ঠ যেন আরও বেশি মানিয়ে গেল। বড় অ্যারেনায় এত ব্যক্তিগত অনুভূতি খুব কমই তৈরি হয়।
শো শেষে আলো জ্বলে উঠলেও মনে রইল না পরিপূর্ণতার ছাপ—বরং একজন শিল্পীর সেই সাহস, যিনি নিজেকে স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে রাখতে অস্বীকার করেন। বরং তিনি আজও কৌতূহল, অন্তর্দৃষ্টি আর নীরব এক বিদ্রোহের ভরসায় নিজের সুরকে নতুন করে গড়ে চলেছেন। এই রাতটা তাই ছিল একসঙ্গে ভঙ্গুর, আবার অবিস্মরণীয়।
ডিলানের জীবনযাত্রা যেকোনো শিল্পীর জন্য শেখার মতো। ছোটবেলায় তাঁর গিটার বাজানো নিয়ে হাসাহাসি হতো, গলা কখনোই ছিল না রেডিও বা পপ তারকাদের মতো। তবু তিনি যা আছে, তাকেই শক্তিতে পরিণত করেছেন—আর এখনো তা–ই করে যাচ্ছেন। শক্তিশালী ব্যান্ড তাঁকে সুরে রাখে, আর তিনি জ্যাজশিল্পীর মতো সেই ভিত্তির ওপর নিজের অনন্য সুর তৈরি করেন, প্রতিটি রাতে নতুনভাবে।
জীবনের বাকেট লিস্টের একটা বড় টিক আজ হয়ে গেল—সরাসরি দেখে নিলাম কবিদের কবি, গায়কদের গায়ক, কিংবদন্তি—বব ডিলানকে।