জুবিনের হঠাৎ মৃত্যু যেন থমকে দিল আসামকে। কোলাজ
জুবিনের হঠাৎ মৃত্যু যেন থমকে দিল আসামকে। কোলাজ

জুবিন গার্গের শেষযাত্রায় আসাম যেন থমকে গেল

২০০৬ সাল। অনুরাগ বসুর ছবি ‘গ্যাংস্টার’ মুক্তি পেয়েছিল ইমরান হাশমি, কঙ্গনা রনৌত আর শাইনি আহুজাকে নিয়ে। তেমন সাড়া ফেলেনি গল্প কিংবা অভিনয়, কিন্তু ছবি শেষ হওয়ার অনেক পরেও আলোচনায় রইল গানগুলো। বিশেষ করে একটি গান—‘ইয়া আলী’। কলেজ ক্যানটিন থেকে শুরু করে পাড়ার ক্যাসেট দোকান, রাতের বাস থেকে হোস্টেলের দেরি রাতের আড্ডা—সবখানেই বাজতে থাকে গানটি। আর এর পেছনে যে কণ্ঠস্বর, সেটি এক প্রজন্মের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়—জুবিন গার্গ।

প্রায় দুই দশক পর, হঠাৎ মৃত্যু যেন ‘অবশ’ করে দিল আসামকে। প্রিয় শিল্পীকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল গুয়াহাটি শহর। দোকানপাট বন্ধ, সেবা কার্যত অচল। যেন কোনো শিল্পীকে নয়, নিজেদেরই এক টুকরা সত্তাকে হারাল আসামবাসী।
শহর থমকে গেল

৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথজুড়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেন শিল্পীকে শেষবার দেখতে। এএফপি

গতকাল রোববার, গুয়াহাটির লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলই বিমানবন্দর থেকে কাহিলিপাড়া পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথজুড়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেন শিল্পীকে শেষবার দেখতে। আগের রাতেই সিঙ্গাপুর থেকে পৌঁছায় তাঁর মরদেহ। সাঁতার কাটতে গিয়ে খিঁচুনির কারণে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর।

জুবিন গার্গ। গায়কের ফেসবুক থেকে

ফুলে সাজানো অ্যাম্বুলেন্স যখন ধীরে ধীরে শহরে ঢুকল, সাধারণত আধা ঘণ্টার পথ পেরোতে লেগে গেল পাঁচ ঘণ্টার বেশি। কারণ, রাস্তার দুই পাশে ভিড় করেছিল হাজারো মানুষ। প্রবীণ, নারী, শিশু, তরুণ-তরুণী, প্রতিবন্ধী—সবাই হাতে ফুল, চোখে জল, ঠোঁটে প্রার্থনা। অনেকে শুধু নাম ধরে ডাকছিলেন ‘জুবিনদা…।’

ফুলে সাজানো অ্যাম্বুলেন্স যখন ধীরে ধীরে শহরে ঢুকল, সাধারণত আধা ঘণ্টার পথ পেরোতে লেগে গেল পাঁচ ঘণ্টার বেশি। এএফপি

গুয়াহাটির শিল্পী রূপম মুদই বললেন, ‘প্রতিটি দোকানের সামনে ধূপ জ্বালানো, ফুল দিয়ে ছোট ছোট স্টল বানানো, সবাইকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে দেখা গেছে। এভাবে একসঙ্গে এত ভালোবাসা খুব কম শিল্পীই পেয়েছেন।’

শোক দিবস
শুধু রাস্তা নয়, গুয়াহাটি শহর যেন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ—এমনকি খাবার ডেলিভারি সার্ভিসও বন্ধ থাকে। অনেকেই একে ‘ব্ল্যাক ডে’ বলছেন। তবে সব দোকান যে স্বেচ্ছায় বন্ধ ছিল, তা নয়। ভক্তদের আবেগ এতটাই তীব্র ছিল যে অনেক ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করে দোকান বন্ধ রাখা হয়।

জুবিন গার্গ

স্থানীয় সাংবাদিক অনিতা গোস্বামী বলেন, ‘শ্রদ্ধা জানানো হোক আন্তরিকতার জায়গা থেকে। জোর করে বা ভয় দেখিয়ে দোকান বন্ধ রাখা সমীচীন নয়। কিন্তু বুঝতে হবে, আমরা আমাদেরই একজনকে হারিয়েছি।’

শেষ বিদায়ের আয়োজন
গুয়াহাটি পৌঁছে মরদেহ যখন কাহিলিপাড়ার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে পরিবারকে কিছুটা সময় দেওয়া হয়। আসামে প্রচলিত গামছা দিয়ে ঢেকে কাচের কফিনে রাখা হয় জুবিন গার্গকে।

জুবিন গার্গ

কনভয়ের মধ্যে ছিল তাঁর প্রিয় খোলা জিপ, যেটিতে কনসার্টে যাওয়া-আসা করতেন তিনি। সেই গাড়িতে রাখা ছিল তাঁর বড় ছবি। ভক্তরা মশাল, ধূপ, মোমবাতি হাতে এগিয়ে চলেছেন, গাইছেন তাঁর গান মায়াবিনী—যেটি মৃত্যুর পর শোনানোর ইচ্ছা তিনি নিজেই প্রকাশ করেছিলেন।

তিন দশকের সংগীতযাত্রা
তিন দশকের বেশি সময় ধরে ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় ৩৮ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন জুবিন গার্গ। শুধু একজন গায়ক নন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আসামের সাংস্কৃতিক অহংকার, যিনি রাজ্যকে পৌঁছে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে।
বিমানবন্দরে মরদেহ গ্রহণ করতে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী পবিত্র মার্ঘেরিটা এবং রাজ্যের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। স্ত্রী গারিমা শইকিয়া গার্গ ভেঙে পড়েন কফিন জড়িয়ে ধরে।

‘এখানে তিনি কেবল একজন শিল্পী ছিলেন না, দেবতার মতো ছিলেন। আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন। তাই এই হারানোটা মেনে নেওয়া এত কঠিন,’ বললেন অনিতা গোস্বামী।

শেষ বিদায়ের অপেক্ষা
সরকার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি তাঁর শেষকৃত্য কোথায় হবে। গুয়াহাটির কাছে সোনাপুরে বা জোরহাটে—দুই জায়গাই বিবেচনায় আছে। ভক্তরা চাইছেন জোরহাটে স্মৃতিসৌধ হোক, কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ বাবার যাতায়াতের কষ্ট নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
মাংলাদইয়ের প্রকৌশলী মিমলি বরদলই বললেন, ‘আসাম এক অমূল্য রত্ন হারাল। আর কখনো তাঁর মতো কেউ আসবেন না।’

জুবিন গার্গ

জুবিন গার্গ শুধু গান গাওয়া কণ্ঠস্বর ছিলেন না, তিনি এক প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সঙ্গী ছিলেন। তাঁর চলে যাওয়া তাই শুধু শোক নয়, এক শহরের স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো গভীর এক ব্যথা; যা চাইলেও ভুলে থাকা যায় না।

তথ্যসূত্র: এনডিটিভি