
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে নির্মিত সব চলচ্চিত্রের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, তাতে যোগ দিয়েছেন মার্কিন অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। তিনি ট্রাম্পকে ‘শিল্পবিরোধী প্রেসিডেন্ট’ আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ঢেউ এসে পড়েছে ফ্রান্সের কান শহরে আয়োজিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র উৎসবে। ঘটনা তাহলে কী দাঁড়াল!
কান কর্তৃপক্ষ শুধু ‘সিনেমার জন্যই সিনেমা’ উৎসব আয়োজন করে বলে একধরনের গর্ববোধ করত। কিন্তু রবার্ট ডি নিরোর বক্তব্য তাতে নতুন করে প্রশ্ন এঁকে দিয়েছে। ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী দিনে সম্মানসূচক স্বর্ণপাম দেওয়া হয় অস্কারজয়ী অভিনেতা রবার্ট ডি নিরোকে। পুরস্কার গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেন ৮১ বছর বয়সী অভিনেতা। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প শিল্পের শত্রু।’
শুধু এখানেই থামেননি নিরো। তিনি দর্শকদের কোনো সহিংসতা ছাড়াই অত্যন্ত আবেগ ও দৃঢ়তার সঙ্গে একত্র হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যাঁরা স্বাধীনতার কথা ভাবেন, তাঁদের সংগঠিত হওয়ার, প্রতিবাদ করার এবং যখন ভোট আসে, ভোট দেওয়ার সময় এসেছে। ভোট দিন। চলুন, আজ রাতে এবং পরবর্তী ১১ দিন ধরে আমরা গৌরবময় উৎসবে শিল্প উদ্যাপন করে আমাদের শক্তি ও প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করি। স্বাধীনতা, নৈতিকতা, ভ্রাতৃত্ব।’
কানের এবারের আয়োজনে সঞ্চালকের দায়িত্বে রয়েছেন ফরাসি অভিনেতা লরাঁ লাফিত। তিনিও একই রকম আবেগঘন বক্তব্য দেন উদ্বোধনী দিনে। তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক আলাপও উঠে আসে। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অভিনয়শিল্পীদের নিজ নিজ জায়গা থেকে বাস্তব জগতের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
কানের জুরিপ্রধান অস্কারজয়ী অভিনেত্রী জুলিয়েত বিনোশও একই সুরে কথা বলেন। বিনা কারণে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার যে মানসিকতা, তা রোধ করা এবং জলবায়ু বিপর্যয় ও নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার আহ্বান ছিল তাঁর বক্তব্যে। এ ছাড়া তিনি ‘বর্বরতার দানব’দের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কথা বলেছেন।
প্রশ্ন হলো সবাই কেন একই সুরে কথা বলছেন? এবারের আসরে কি তাহলে রাজনীতি ঢুকে পড়ল?
গত ১৬ এপ্রিল ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় মারা যান গাজার ২৫ বছর বয়সী শিল্পী ফটোসাংবাদিক ফাতিমা হাসুউনা। সঙ্গে তাঁর পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হন। ফাতিমাকে উপজীব্য করে সেপিদেহ ফারসির বানানো তথ্যচিত্র ‘পুট ইয়োর সোল অন ইয়োর হ্যান্ডস অ্যান্ড ওয়াক’ এবারের কানে প্রদর্শিত হয়েছে।
ফাতিমার মৃত্যুর পর রিচার্ড গিয়ার, হাভিয়ের বারদেম, মার্ক রাফেলো, সুসান সারানডোনের মতো বিশ্বের প্রায় ৩৫০ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ‘ফর ফাতেম’ শিরোনামে একটি খোলাচিঠি লেখেন। চিঠিটি ফ্রান্সের লিবারেশন পত্রিকায় ছাপা হয়। গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার মারাত্মক প্রভাবের বিষয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্প্রদায়ের ‘নীরবতা ও উদাসীনতা’র প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে চিঠিতে। ফলে কানের এবারের আসর শুরুর আগেই রাজনৈতিক সুর তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্প্রদায়কে এবারের কানে শান্তির পক্ষে কথা বলার আহ্বান জানিয়ে ‘ফর ফাতেম’ চিঠিটি নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন দুবারের অস্কারজয়ী নির্মাতা কেন লোচ এবং চিত্রনাট্যকার ও আইনজীবী পল লেভার্টি। তাঁরা লেখেন, ‘কিছুদিনের জন্য বিশ্বের সবার নজর কানের দিকে থাকবে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা এখানে উপস্থিত হয়ে বোঝার চেষ্টা করেন, কোন দেশের চলচ্চিত্র কীভাবে গড়ে উঠছে।’ চিঠিতে তাঁরা ১৯৬৮ সালের কানের কথা তুলে আনেন।
কী হয়েছিল সে বছর
কেন লোচ ও পল লেভার্টি তাঁদের চিঠিতে ১৯৬৮ সালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সে বছরও কান উৎসব রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কী ঘটেছিল সে বছর? ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন ছাত্ররা। সাত সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলনটি ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লব নামে পরিচিত। সে বছর শুরু হওয়া ২১তম কান চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। তৎকালীন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জ্যঁ লুক গদার ও ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর নেতৃত্বে একদল তরুণ নির্মাতা মঞ্চের পর্দা ধরে ঝুলে পড়ে মাঝপথে বন্ধ করে দেন উৎসব।
শুরুটা হয়েছিল পিছিয়ে
বিখ্যাত লেখক ফিলিপ্পে এরল্যাঙ্গার ১৯৩৮ সালে প্রথম কান উৎসব আয়োজনের ধারণা দেন। ১৯৩৯ সালে হওয়ার কথা ছিল প্রথম আসর। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের পরিবেশ পেরিয়ে ১৯৪৬ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে বসে প্রথম আসর।
এ বছর আরও যা হচ্ছে
কান কর্তৃপক্ষ এবারের আসরের উদ্বোধনী দিনটিকে রুশ বাহিনীর আগ্রাসনে বিরুদ্ধে ইউক্রেনের জনগণের লড়াইয়ের প্রতি উৎসর্গ করা হয়। নিয়মিত বিভাগের বাইরে গিয়ে কর্তৃপক্ষ তিনটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
তা ছাড়া এ বছর জেরার্দ দেপার্দিউর বিরুদ্ধে ওঠা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়। পাশাপাশি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ফরাসি অভিনেতা থিও নাভারো-মুসিকে কানের লালগালিচায় হাঁটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয় কর্তৃপক্ষ।
এবার উৎসবের প্রথম দিনই তৈরি হয় ‘পোশাক-বিতর্ক’। কারণ, এবার উৎসব শুরুর এক দিন আগে কানের লালগালিচায় ‘নগ্ন’ বা ‘অতিরিক্ত লম্বা’ পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এটা অবশ্য নতুন নয়, তবে এবার তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এমন সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ১৯৬৮ সালের মতো করেই এ বছর সবাই জেগে উঠেছেন। যদিও ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখার জন্য উৎসবের সঙ্গে জড়িত সবার প্রতি কঠোর নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু সেটা আর ধরে রাখা যাচ্ছে কোথায়!