
অভিনেত্রী, গায়িকা ও প্রাণী অধিকারকর্মী ব্রিজিত বার্দো ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ফ্রান্সের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম কোনো তারকা হিসেবে ‘মারিয়েন’-এর মডেল হন—ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রতীক এবং ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে দেশের সিটি হল, সরকারি নথি, ডাকটিকিট ও মুদ্রায় যাঁর উপস্থিতি রয়েছে। এর ঠিক এক বছরের কিছু বেশি আগে তিনি তাঁর টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘লে শো বার্দো’ শুরু করেন—হাঁটু ছাড়ানো বুট আর একটি ফরাসি পতাকা ছাড়া প্রায় কিছুই পরেননি, জাতীয় সংগীত বাজতে বাজতে যা দ্রুত রূপ নেয় প্রাণবন্ত একটি পপগানে।
‘বি.বি.’ নামে পরিচিত বার্দো ছিলেন এক নতুন ফ্রান্স—সাহসী, মুক্তচিন্তার এবং প্রচলিত ধারা ভাঙার। তবে বার্দো কখনোই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো চরিত্র ছিলেন না। বলা যায়, আধুনিক যুগের প্রথম দিককার ‘সমস্যাজনক’ তারকাদের একজন তিনি। একই সঙ্গে প্রশংসিত ও নিন্দিত—কখনো পালাক্রমে, কখনো একসঙ্গেই। তাঁকে খারাপ অভিনেত্রী বলা হয়েছে, বলা হয়েছে খিটখিটে, ছাঁকনি ছাড়া কথা বলা একঘেয়ে মানুষ; আবার আধুনিকতা ও মুক্তির প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন প্রাণী অধিকারের জন্য নিরলস সংগ্রামী, যিনি চরম ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং ‘জাতিগত ঘৃণা উসকে দেওয়ার’ অভিযোগে একাধিকবার দোষী সাব্যস্ত হন।
বি.বি.’ নামে পরিচিত বার্দো ছিলেন এক নতুন ফ্রান্স—সাহসী, মুক্তচিন্তার এবং প্রচলিত ধারা ভাঙার। তবে বার্দো কখনোই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো চরিত্র ছিলেন না। বলা যায়, আধুনিক যুগের প্রথম দিককার ‘সমস্যাজনক’ তারকাদের একজন তিনি।
তাঁকে ‘ক্যানসেল’ করার জন্য কাউকে এগিয়ে আসতে হয়নি, এক অর্থে তিনি নিজেই সেটা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে অভিনয় ছেড়ে দেন তিনি। তারকাদের অবসর নেওয়ার বহু ঘটনার বিপরীতে এই সিদ্ধান্ত আর বদলায়নি। কেউ কেউ বলতে পারেন, এতে তাঁর হাতে এত সময় চলে আসে যে তিনি নানা ঝামেলায় জড়ান। কিন্তু ভালো হোক বা মন্দ—তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন এবং সেটাই পেয়েছিলেন।
মারিয়েন হওয়ার অনেক আগেই বার্দোর কাঁধে ছিল আরও ভারী এক বোঝা—তিনি যেন নারীসত্তারই প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘…অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান’ ছবিটি তাঁকে মাত্র কুড়ির কোটায় তারকাখ্যাতি এনে দেয়।
তাঁর তৎকালীন স্বামী রজার ভাদিমের পরিচালনায় বার্দো এমন এক কামুক, আপসহীন যৌন আবেদন প্রকাশ করেন, যা দেখে মনে হয়েছিল, ফ্রান্স যেন হঠাৎ জানালা খুলে দিয়ে টাটকা হাওয়ার ঝাপটা গ্রহণ করছে। ২০১৮ সালে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ লেখক এ ও স্কট ছবিটিকে বর্ণনা করেন ‘যৌনতা, রোদ আর ফ্রান্সের এক বিশেষ চিত্র নির্মাণের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত’ হিসেবে।
১৯৭৩ সালে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে অভিনয় ছেড়ে দেন তিনি। তারকাদের অবসর নেওয়ার বহু ঘটনার বিপরীতে এই সিদ্ধান্ত আর বদলায়নি। কেউ কেউ বলতে পারেন, এতে তাঁর হাতে এত সময় চলে আসে যে তিনি নানা ঝামেলায় জড়ান।
আর যেহেতু এটা ফ্রান্স, তাই খুব দ্রুতই বার্দো বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৫৮ সালে মার্গারিত দুরাস ‘কুইন বার্দো’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। পরের বছর সিমোন দ্য বোভোয়ার এস্কোয়ার পত্রিকায় লেখেন ‘ব্রিজিত বার্দো অ্যান্ড দ্য লোলিটা সিনড্রোম’—একটি প্রশংসাসূচক লেখা, যেখানে তিনি বার্দোর প্রাণীর প্রতি ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করেন এই আশা প্রকাশ করে, ‘আমি আশা করি, জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য তিনি নিজেকে তুচ্ছ করে ফেলবেন না। আমি আশা করি, তিনি পরিণত হবেন, কিন্তু বদলে যাবেন না।’
১৯৫৬ সালের সাফল্যের পর বার্দো এমন এক ঘূর্ণির মতো তারকাখ্যাতিতে ঢুকে পড়েন, যেখানে তিনি কখনোই স্বস্তি বোধ করেননি। পাপারাজ্জিদের তাড়া, প্রেমের খোঁজে একের পর এক সম্পর্ক ও বিয়ে, আর উন্মত্ত গতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ—সব মিলিয়ে জীবন ছিল অস্থির।
‘ব্রিজিত বার্দো বা নারীদের কমেডির “সমস্যা”’ শীর্ষক প্রবন্ধে গবেষক জিনেত ভিনসঁদো দেখান, বার্দোকে ঘিরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাঁর যৌন আবেদন। অথচ তাঁর বেশির ভাগ সফল ছবি ছিল কমেডি—১৯৫৬ সালের ‘নটি গার্ল’ থেকে শুরু করে যেগুলো তাঁর স্বাভাবিক উচ্ছলতা, প্রাণশক্তি এবং ‘বোকার মতো সুন্দরী’ ধারণাটিকে উল্টে দেওয়ার ক্ষমতার কারণে জনপ্রিয় হয়েছিল।
এই ছবিগুলো বক্স অফিসে দারুণ সফল হলেও বার্দো গম্ভীর ধারার ছবিতেও সমান দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। বিশেষ করে অঁরি-জর্জ ক্লুজোর অন্ধকারধর্মী নাটক ‘দ্য ট্রুথ’ (১৯৬০) এবং জ্যঁ-লুক গদারের সিনেমার প্রতি প্রেমময় শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘কনটেম্পট’ (১৯৬৩) উল্লেখযোগ্য।
১৯৫৬ সালের সাফল্যের পর বার্দো এমন এক ঘূর্ণির মতো তারকাখ্যাতিতে ঢুকে পড়েন, যেখানে তিনি কখনোই স্বস্তি বোধ করেননি। পাপারাজ্জিদের তাড়া, প্রেমের খোঁজে একের পর এক সম্পর্ক ও বিয়ে, আর উন্মত্ত গতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ—সব মিলিয়ে জীবন ছিল অস্থির।
১৯৬০-এর দশক ছিল বার্দোর যুগ। সিনেমার পাশাপাশি তিনি ১৯৬২ সালে প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম গান ‘সিদোনি’ (যেটি লুই মাল-এর সঙ্গে তাঁর প্রথম ছবি ‘আ ভেরি প্রাইভেট অ্যাফেয়ার’-এ ব্যবহৃত হয়)। এরপর তিনি গড়ে তোলেন একটি সমৃদ্ধ ডিস্কোগ্রাফি—যেখানে ছিল অনাসক্ত, রসিক ও তীক্ষ্ণ পরিবেশনা। ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি প্রচারিত একটি টিভি অনুষ্ঠান দ্রুতই কাল্ট মর্যাদা পায়, বিশেষ করে সের্জ গাঁসবুর্গের নতুন গান ‘কমিক স্ট্রিপ’, ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ ও ‘হার্লে ডেভিডসন’-এর সৃজনশীল উপস্থাপনার জন্য।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক এডগার মরাঁ তাঁর ‘দ্য স্টারস’ (১৯৭২) বইয়ে লেখেন, বার্দোর মধ্যে ছিল ‘চরম নিষ্কলুষতা ও চরম যৌনতার অসাধারণ গুণাবলি’—এই দ্বৈততা তাঁকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যৌন সাহসিকতার জন্য তাঁর সুনাম থাকলেও তিনি গাঁসবুর্গকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁদের উত্তপ্ত দ্বৈত গান ‘জ্যঁ তেম… মোয়া নঁ প্লু’ প্রকাশ না করতে। গানটি তাঁরা ১৯৬৭ সালে সম্পর্কের সময় রেকর্ড করেছিলেন। গাঁসবুর্গ তাঁর অনুরোধ মানেন এবং পরে ১৯৬৯ সালে জেন বারকিনের সঙ্গে নতুন করে গানটি রেকর্ড করেন—যা হিট হয়। (বার্দোর সংস্করণটি শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে)।
গান গাওয়ার প্রতি তাঁর এতটাই অনুরাগ ছিল যে সিনেমা ছাড়ার পরও তিনি এই ধারায় সক্রিয় থাকেন। তাঁর শেষ গান ‘তুত লে বেত সঁ আ এমে’—অর্থাৎ ‘সব প্রাণীকেই ভালোবাসতে হবে’—প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে, সিনেমা ছাড়ার প্রায় এক দশক পরে।
চূড়ান্ত মোড় আসে ১৯৭৩ সালে, তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘দ্য এডিফাইং অ্যান্ড জয়াস স্টোরি অব কোলিনো’ নির্মাণের সময়। তিনি লক্ষ করেন, একজন অতিরিক্ত শিল্পীর সঙ্গে একটি ছোট ছাগল আছে এবং জানতে পারেন, ছাগলটি বারবিকিউয়ের জন্য নির্ধারিত। আতঙ্কিত হয়ে বার্দো সেটি কিনে নেন। পরে তিনি বলেন, এই ঘটনাই তাঁকে অভিনয় ছেড়ে প্রাণী অধিকারের আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছিল।
১৯৯৪ সালে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় প্রাণী ভালোবাসতাম। কিন্তু সিনেমা করতে গিয়ে বুঝলাম, প্রাণী ভালোবাসা আর তাদের জন্য লড়াই করা এক জিনিস নয়। লড়াই করার সময় আমার ছিল না। তাই আমি সিনেমা ছেড়ে দিয়েছি। প্রাণীদের দেখাশোনা করতেই আমি অভিনয় বন্ধ করেছি।’
আমি সব সময় প্রাণী ভালোবাসতাম। কিন্তু সিনেমা করতে গিয়ে বুঝলাম, প্রাণী ভালোবাসা আর তাদের জন্য লড়াই করা এক জিনিস নয়। লড়াই করার সময় আমার ছিল না। তাই আমি সিনেমা ছেড়ে দিয়েছি। প্রাণীদের দেখাশোনা করতেই আমি অভিনয় বন্ধ করেছি।’দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিজিত বার্দো
ভূমধ্যসাগরীয় শহর সাঁ-ত্রোপেতে নিজেকে গুটিয়ে নেন বার্দো, যেখানে তাঁর দুটি সম্পত্তি ছিল—এর একটি তাঁর গান ‘লা মাদ্রাগ’ থেকে বিখ্যাত। সেখান থেকেই তিনি পুরো সময়জুড়ে এমন একধরনের চরমপন্থী সক্রিয়তায় নিজেকে নিয়োজিত করেন, যা সাধারণত তারকাদের মধ্যে দেখা যায় না।
‘আমি শুধু প্রাণী সুরক্ষার জগতেই বাস করি,’ তিনি ১৯৯৪ সালের সেই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি শুধু সেটাই বলি, সেটাই ভাবি। আমি এ নিয়ে আচ্ছন্ন।’ অন্য কিছু যেন আর গুরুত্বই পায়নি। ১৯৮৬ সালে তিনি নিজের অনেক সম্পত্তি বিক্রি করে প্রাণী সুরক্ষামূলক অলাভজনক সংস্থা ব্রিজিত বার্দো ফাউন্ডেশন-এর অর্থায়নে সহায়তা করেন।
বছরের পর বছর পেরোতে পেরোতে বার্দো রাজনীতির জন্যও ঠিক ততটাই পরিচিত হয়ে ওঠেন, যতটা একসময় ছিলেন তাঁর পেশাগত জীবনের জন্য। তিনি নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিতেন, খোলাখুলি মত দিতেন—সাধারণত বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে, বিশেষ করে নিজের দেশকে নিয়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি বিশ্বাস করতেন যে কেবল ডানপন্থী রাজনীতিই (ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং তার উত্তরসূরি ন্যাশনাল র্যালির মতো চরম পর্যায় পর্যন্ত) একটি অবক্ষয়গ্রস্ত ফ্রান্সকে বাঁচাতে পারে। চলতি বছরের শুরুতে তিনি জেরার দেপারদিয়ু ও নিকোলা বেদোর প্রতি সমর্থন জানান—যাঁরা দুজনই যৌন নিপীড়নের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে লে মঁদ পত্রিকাকে দেওয়া এক ফোন সাক্ষাৎকারে বার্দো বলেন, ‘আমার কিছুই দরকার নেই। আমি যেভাবে বাঁচি, তার জন্য যা দরকার, সবই আমার আছে। আমার যা আছে, তার বেশি আমি কখনো চাই না।’
সিমোন দ্য বোভোয়ার যেমনটি আশা করেছিলেন—তিনি বদলাননি।