Thank you for trying Sticky AMP!!

বডি শেমিং কখনোই নয়

৯ বছরের কিশোর শাওন (ছদ্মনাম)। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। লম্বায় সে খানিকটা খাটো। ক্লাসের অন্যরা তাই তার নাম দিয়েছে ‘বাঁটু শাওন’। ক্লাসে আরেকজন শাওন (ছদ্মনাম) আছে, সে কথা কম বলে, তাই তার নাম ‘মিচকা শাওন’। ‘বাঁটু’ বলাতে প্রথম প্রথম শাওন তেমন কিছু মনে করত না। তবে আজকাল তার খুবই খারাপ লাগে। বন্ধুরা প্রায়ই তার মাথায় হাত বোলায়, চাটি মারে আর ‘বাঁটু শাওন বাঁটু শাওন’ বলে খ্যাপায়। মন খারাপ করে সে আর স্কুলে যেতে চায় না। করোনায় স্কুল বন্ধ হওয়াতে সে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিল। তবে অনলাইন ক্লাসেও বন্ধুরা সুযোগ পেলেই তাকে ‘বাঁটু’ বলে ত্যক্ত করে। এ জন্য সে অনলাইন ক্লাসেও অনিয়মিত।

শাওনের মতো অনেকেকেই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। ওজন বেশি হলে ‘মোটকু’, শীর্ণকায় হলে ‘চিকনা’ বেশি লম্বা হলে ‘লম্বু’ ইত্যাদি শব্দবাণে জর্জরিত হতে হয়। গায়ের রং নিয়ে নারী-পুরুষ সবাইকে বিদ্রূপের শিকার হতে হয়। যেটাকে বলা হয় ‘বডি শেমিং’। অনেক সময় কেউ নিছক মজার জন্য এমন করেন, কেউ আবার না বুঝেই এমন মন্তব্য করে ফেলেন, যেটা অপরের জন্য মনোকষ্টের কারণ হয়। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, গড়ে ৪৫ শতাংশ কিশোর–কিশোরী জীবনে কখনো না কখনো বডি শেমিংয়ের মুখোমুখি হয়েছে।

বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ছেলেশিশুদের প্রতি বডি শেমিং বেশি হয়ে থাকে। যারা বডি শেমিংয়ের মুখোমুখি হয়, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। নিজের শারীরিক গড়ন, গায়ের রং ইত্যাদি নিয়ে একধরনের হতাশায় ভোগে, নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়।

২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪২ লাখের বেশি লোক প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজেদের গড়ন পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই বডি শেমিংয়ের কারণে। কেউ কেউ বডি শেমিংয়ের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট দেখে নিজের গড়ন পরিবর্তন করার জন্য অপ্রতিষ্ঠিত, টোটকা বিকল্প ডায়েট গ্রহণ করে নিজের জীবনকেও বিপন্ন করে ফেলেন।

কারা বডি শেমিং করেন

সবাই কি বডি শেমিং করেন? উত্তর হচ্ছে, না। একধরনের লোক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অন্যজনকে বিদ্রূপ করে থাকেন। যাঁরা এই বিদ্রূপ করেন, দেখা যায় কখনো কখনো তাঁরা নিজেরাই হীনম্মন্যতায় ভোগেন বা তাঁদের ব্যক্তিত্বের সমস্যা আছে। যিনি নিজে ব্যক্তিজীবনে বা পেশাগত ক্ষেত্রে কোথাও পরাজিত বা হতাশ, তিনিই কিন্তু বেশি বেশি বডি শেমিং করে থাকেন। যাঁরা নিজেরা একসময় বডি শেমিংয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্যেও অপরকে বডি শেমিং করার প্রবণতা থাকতে পারে। যদি কারও মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকার (পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার) থাকে, তবে কখনো তাঁরাও অপরকে বডি শেমিং করে থাকেন।

কেউ কেউ হয়তো নিছক সরলমনে হাসিঠাট্টার ছলে এমন কোনো মন্তব্য করে ফেলেন, যা অপরের মনোকষ্টের কারণ হতে পারে। অনেক সময় সেলফ বডি শেমিংও হতে পারে। সরাসরি কারও মন্তব্য ছাড়াই অনেক সময় কেউ কেউ নিজের গড়ন নিয়ে আরেকজনের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে থাকেন। ‘ইশ্‌ আমার নাকটা যদি অমুক নায়িকার মতো হতো’, ‘আহা! আমি যদি ওর মতো লম্বা হতাম’। এ ধরনের হতাশা কেউ নিজেই ব্যক্ত করে থাকেন। যেটি দিন শেষে তাঁকে একধরনের মানসিক বৈকল্যের দিকে নিয়ে যায়। বডি শেমিং পরিবারের মধ্য থেকে হতে পারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে হতে পারে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বডি শেমিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে। চেহারা, শরীরের ওজন, কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য, গায়ের রং, জামাকাপড়, স্টাইল, চুলের কাট, হাঁটাচলার ভঙ্গি, ফ্যাশন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বডি শেমিং হয়ে থাকে।

কী হয় বডি শেমিং থেকে

শিশু-কিশোর, নারী–পুরুষ যেকোনো বয়সী ব্যক্তির প্রতিই বডি শেমিং হতে পারে। যাঁদের প্রতি বডি শেমিং হয়, তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

মানসিক চাপ: কারও প্রতি বডি শেমিং হলে প্রথমেই তিনি নিজের মধ্যে একধরনের মানসিক চাপ (স্ট্রেস) অনুভব করেন। কীভাবে নিজের গড়ন পরিবর্তন করতে পারেন, তা নিয়ে একধরনের দুশ্চিন্তায় পড়ে যান।

রাগ: যাঁরা তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করলেন, তাঁদের প্রতি তীব্র রাগ জন্মে। সেখান থেকে অনেক সময় আগ্রাসী আচরণ করে ফেলেন।

বিষণ্নতা: নিজের গড়ন নিয়ে হতাশা জন্মে, হতাশা থেকে বিষণ্নতা রোগে ভুগতে পারেন কেউ কেউ। আত্মবিশ্বাস কমে যায়, নিজেকে ছোট ভাবা শুরু করেন, কাজের মান কমে যায়।

বডি ডিজমরফিক ডিজঅর্ডার: নিজের গড়ন নিয়ে এতটাই আচ্ছন্ন থাকেন যে কারও সামনে যেতে চান না। নিজেকে গুটিয়ে রাখেন, দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা কেবল নিজের চেহারা, গড়ন বা গায়ের রং পরিবর্তন কীভাবে করা যায়, সেটা ভাবতে থাকেন এবং সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক–অবৈজ্ঞানিক বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে চান।

ইটিং ডিজঅর্ডার: ওজন কমাতে গিয়ে কম খান বা খাওয়ার পরপরই বমি করেন। দ্রুত ওজন কমাতে গিয়ে ক্ষতিকর ডায়েট গ্রহণ করেন। ‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ নামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যেটায় মৃত্যুঝুঁকি আছে।

আত্মহত্যা: বডি শেমিং থেকে বিষণ্নতা এবং নিজেকে অপাঙ্‌ক্তেয় বোধ থেকে কেউ কেউ নিজেকে আঘাত করা বা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলেন।

ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন: শৈশবে বা কৈশোরে বডি শেমিংয়ের মুখোমুখি হলে পরিণত বয়সে কারও কারও মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকার (পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার) দেখা দিতে পারে।

করণীয় কী

কোনো প্রতিষ্ঠানে বডি শেমিংয়ের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবারে বডি শেমিং হতে পারে, এমন কোনো আচরণ উৎসাহিত করা যাবে না। শিক্ষকেরা নিজেরা যেন কখনো কোনো শিক্ষার্থীকে বডি শেমিং করে না ফেলেন, সেদিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।

পরিবারে কোনো শিশুর মধ্যে বিশেষ গড়ন বা বৈশিষ্ট্য থাকলে সেটা নিয়ে তাকে ব্যঙ্গ করবেন না। বিষয়টি তাকে বুঝিয়ে বলুন এবং এটি যে তার জন্য মোটেও লজ্জার নয়, সেটি ব্যাখ্যা করুন। তার গুণাবলির জন্য তাকে প্রশংসা করুন। কারও সঙ্গে তার তুলনা করবেন না।

কারও প্রতি বডি শেমিং হয়ে থাকলে তাঁর প্রতি সমানুভূতি দেখান। তাঁর পাশে থাকুন। প্রতিবাদ করতে না পারলেও তাঁকে মানসিক সাহায্য দিন।

যিনি বডি শেমিংয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন, তিনি বিশ্বাস করবেন যে কেবল শরীর বা গায়ের রংটিই তাঁর পরিচয় নয়। এর বাইরেও তাঁর ব্যক্তিত্ব রয়েছে। অপরের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নিজেকে পরিচালিত করতে হবে। যিনি আপনাকে বিদ্রূপ করছেন, তাঁকে প্রয়োজনে চ্যালেঞ্জ করুন। তাঁকে বলুন যে আপনার শারীরিক গড়নে বিশেষত্ব থাকতে পারে, কিন্তু একজন মানবিক মানুষ হিসেবে আপনি তাঁর চাইতে অনেক বড় এবং হীনম্মন্যতামুক্ত। দৃঢ়কণ্ঠে বলুন, ‘আমি আমার মতো, আমি এই আমিকে নিয়েই এগিয়ে যাব।’ নিজেকে আরও বেশি করে ভালোবাসুন এবং প্রতিদিন একবার করে নিজেকে ধন্যবাদ দিন।

অপরের কথার কারণে নয়, কেবল শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় যে বিষয়টি নিয়ে বডি শেমিং হচ্ছে, প্রয়োজনে সে বিষয়ের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। যেমন ওজন কমাতে হলে অবশ্যই হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ বা পেশাদার পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গাইডলাইন রয়েছে কীভাবে ওজন কমানো বা বাড়ানো যায়, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করুন। বডি শেমিং থেকে বাঁচতে ফেসবুক, ইউটিউব দেখে চটকদার টোটকা চিকিৎসায় ওজন কমাতে গেলে প্যানক্রিয়াটাইটিস, লবণ–পানির ভারসাম্যহীনতা, ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বডি শেমিং থেকে বিষণ্নতা, ইটিং ডিজঅর্ডার বা অন্য কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।