সাইবার বুলিং

আমার সন্তান কি অনলাইনে নিরাপদ

ইন্টারনেট জগতে কীভাবে িনজেকে নিরাপদ রাখব, সন্তানকে সে বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। মডেল: রুপন্তি
ছবি: কবির হোসেন

১৩ বছরের নিচে আবার ফেসবুক কী? বড় হও, তারপর ইন্টারনেট পাবে!

কিশোর–কিশোরী সন্তানদের উদ্দেশে বলা এই কথা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন অভিভাবকেরা করোনা মহামারিকালে। করোনাকালে চাকরিজীবীদের হোম অফিসের মতো শিশুদেরও চলেছে বাড়িতে বসে পড়াশোনা—অনলাইন ক্লাস। আর অনলাইন ক্লাসের মাধ্যম তো ইন্টারনেটই।

জুমে ক্লাস হচ্ছে, শিক্ষকেরা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে তাতে নির্দেশনা দিচ্ছেন, স্কুলগুলোও অনলাইনেই রুটিন, পরীক্ষার ফল সরবরাহ করছে। কাজেই ১৩ বছরের আগে ইন্টারনেট দেব না, সে কথা বলার আর জো রইল কই?

চার বছরের শিশুটিকেও ইন্টারনেট ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত হতে হচ্ছে এই সময়। এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী! পড়াশোনা তো আর দিনের পর দিন বন্ধ থাকবে না। কিন্তু আমাদের শিশু–কিশোর সন্তানেরা কি এতে ইন্টারনেটের নানা বিপজ্জনক পরিস্থিতির ঝুঁকিতে পড়ছে? সাইবার বুলিং, যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে না তো?

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি জরিপ বলছে, ৩৬ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু অনলাইনে যৌন হয়রানির শিকার। বন্ধু, সহপাঠী, শিক্ষক, টিউটর যে কেউ অনলাইনে মেয়েশিশুকে হয়রানি করার সুযোগ পাচ্ছেন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কেবল মেয়েশিশু কেন, ছেলেশিশুরাও এর শিকার হতে পারে। ঝুঁকি রয়েছে সেখানেও। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে অভিভাবক হিসেবে সবার আরেকটু সচেতন হওয়ার দরকার আছে। ছোটদের হাতে ইন্টারনেট তুলে দেওয়ার সময় এর সদ্ব্যবহার আর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কেও সচেতন হওয়া উচিত।

আমরা আগে যেমন সন্তানদের বলতাম, বাইরে গেলে অপরিচিত লোকের সঙ্গে হুট করে কথা বলবে না, ডাকলে সাড়া দেবে না, কিছু দিলে নেবে না; ভার্চ্যুয়াল জগৎটাও সে রকম। সন্তানকে বোঝাতে হবে যে এই জগতেও অপরিচিত মানুষ নানা প্রলোভন দিতে পারে, ডাকতে পারে। অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করতে পারে। তাদের এড়িয়ে চলাই উচিত। কিন্তু পরিচিত কেউ যদি বুলিং বা হয়রানি করে? তাহলে কী করা? সে যে–ই হোক, তার সম্পর্কে জানাতে যেন সন্তান দ্বিধাবোধ না করে—এমন পরিবেশ সৃষ্টি করুন। মা–বাবা যেন এত দূরের মানুষ না হন যে সন্তান তার ব্যক্তিগত বিপদ আর বিপন্নতার কথা শেয়ার করতে ভয় পায় বা লজ্জা পায়। এই ভয় কাটানোর অন্যতম উপায় হলো এ নিয়ে কথা বলা।

ইন্টারনেট ব্যবহারের নানা খারাপ দিক সম্পর্কে শিশুর সঙ্গে কথা বলুন। বয়স অনুযায়ী যতটা বলা দরকার। কত রকমের ফাঁদ পাতা আছে এ জগতে, সে সম্পর্কে নিজেও জানুন, সন্তানকেও জানান। লেখাপড়ার জায়গায় নিজের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, পারিবারিক খবর শেয়ার করা যাবে না, তা বুঝিয়ে বলুন। ইন্টারনেট ব্যবহারের নানা নিরাপত্তাসংক্রান্ত দিক আছে, সিকিউরিটি অপশন আছে, সেগুলো সম্পর্কে জানার দরকার অভিভাবকদের। সন্তানের নিরাপত্তার জন্যই অভিভাবকদের শিখতে হবে। ‘আমি তো এগুলো বুঝি না’—এই বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলবে না। দরকার হলে অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপ করুন। যে ভালো বোঝেন, দরকারে তাঁর সাহায্য নিন। সময় পাল্টেছে। সেটা মাথায় রেখে আমাদেরও পাল্টাতে হবে।

তবে কেবল নিজের সন্তানের সুরক্ষা দিলেই চলবে? অন্যের সন্তান যদি সুরক্ষিত ও নিরাপদ না থাকে, তবে সমাজ কীভাবে নিরাপদ থাকবে? যে ৩৬ শতাংশ মেয়েশিশু বন্ধুদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, সেই বন্ধুরা কারা? তারাও আমাদেরই সন্তান। তাহলে একই সঙ্গে ইন্টারনেটে অন্যের প্রতি আচরণ কেমন হবে, তা নিয়েও নিয়মিত বলা উচিত সন্তানকে।

সাইবার জগতের আদবকেতা (নেটিকেট), মেয়ে বন্ধুকে সম্মানের চোখে দেখা, আপত্তিকর মন্তব্য, উদ্ধৃতি বা ছবি শেয়ার না করা, আপত্তিকর বা অশ্লীল সাইটে কাউকে আমন্ত্রণ না জানানো বা ট্যাগ না করা—এই বিষয়গুলো বারবার বলতে হবে।

আপনি যেমন ভয় পাচ্ছেন আপনার স্কুলপড়ুয়া মেয়েশিশুটি হয়রানির শিকার হলো কি না, সেই সঙ্গে এটাও লক্ষ করুন আপনার কলেজ বা ভার্সিটিপড়ুয়া ছেলেটি অন্য কাউকে হয়রানি করছে কি না। দুটোই আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আদবকেতা আর নারীকে সম্মান জানানোর প্রথা পরিবার থেকেই শিখতে হয়। আর এই শিক্ষা প্রতিদিনের আচরণ আর আলাপে প্রস্ফুটিত হওয়া উচিত। আমাদের প্রাত্যহিক আচার–আচরণ ও কথাবার্তাই শিশুদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

কখনো সন্তান কোনো ভুল করে ফেললে তা নিয়ে তুলকালাম করার আগে বুঝিয়ে বলুন। সতর্ক করুন, শোধরানোর সুযোগ দিন। দরকার হলে কাউন্সেলিং বা বিশেষজ্ঞ সাহায্য নিন। শিশুরা জন্ম থেকে অপরাধী হয়ে আসে না, বড় হতে হতে আর শিখতে শিখতে খারাপ কাজ শেখে। তাই কোনো শিশুকে অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সে কেন এমন করল, আর কীভাবে তাকে এ থেকে বের করে আনা যায়!

ইন্টারনেটেও যে ভালো কাজ করা যায়, ভালো জিনিস শেয়ার করা যায়, বন্ধুদের সঙ্গে একটা ভালো গান, একটা ভালো বই নিয়ে আলাপ, কিংবা সমাজের জন্য কোনো কল্যাণকর কাজের উদ্যোগ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি উদাহরণ তুলে ধরা যায়। পড়াশোনার বাইরে আনন্দ উপকরণ, সুস্থ বিনোদন আরও অনেক আছে, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। করোনাকালে ঘরবন্দী শিশু–কিশোরদের এই অনলাইন ক্লাসে বিরক্ত আর বোরিং লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই তাদের গুণগত সময় দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সন্তানের বন্ধু হতে হবে, আপনজন হতে হবে।

আমরা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি সবাই মিলে। সন্তানেরাও তার ব্যতিক্রম নয়। এই সংকুল সময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা জোগাতে পারা এই সময়ের অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।