
‘আপা দোহাই লাগে, আইসিইউর দরজা থেকে এক পাও কোথাও নড়িস না। তুই সরে গেলেই আজরাইল আইসিইউতে ঢুকে পড়বে। আমি কিন্তু ফিরে এসে ছেলেকে তোর কাছ থেকে বুঝে নেব।’ পবিত্র হজ পালন করতে গিয়ে সৌদি আরবে বসে সন্তানের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিজের বড় বোনকে মুঠোফোনে এই আকুতি জানিয়েছিলেন জাহিনের মা নাফিসা হক। তখনো তিনি জানেন না, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা গেছে তাঁর বুকের ধন। ফিরে এসে নিথর ছেলেকে দেখে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন মা। সেই থেকে বুকে জড়িয়ে আছেন জাহিনের সাদা-কালো টি-শার্ট আর নীল রঙের জিনস প্যান্টটি। এই পোশাক বদলে ছেলে সর্বশেষ ঘর থেকে বের হয়েছিল। সেই পোশাকেই জড়িয়ে আছে সন্তানের গায়ের গন্ধ।
পবিত্র ঈদুল আজহার রাতে নগরের এম এম আলী সড়কে গাড়ির ধাক্কায় রিকশা থেকে ছিটকে ঘটনাস্থলেই মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র জাহিন ফাইয়াজ হক (২০)। ওই ঘটনায় আহত হন জাহিনের বন্ধু ও সহযাত্রী মো. রায়হানুল ইসলামও। দুজনেই ঢাকার আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছেলের মৃত্যুর পরদিনই দেশে ফিরে আসেন জাহিনের মা-বাবা।
গত শুক্রবার বিকেলে নগরের রাহাত্তারপুল এলাকায় জাহিনদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, বাড়িভর্তি স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা। এত মানুষ থাকার পরেও বাড়িতে নেই কোনো কোলাহল। বসার ঘরে বসে ছিলেন জাহিনের বাবা মো. জহিরুল হক। তাঁকে ঘিরে আছেন তাঁর বন্ধুরা। ভেজা চোখে মাঝেমধ্যে জাহিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন তিনি। জহিরুল হক-নাফিসা হক দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে জাহিন বড়। ছোট ছেলে আহনাফ রাফিদ হক নগরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। জাহিন পরিবার, স্বজন আর বন্ধুদের কাছে রায়াত নামেই পরিচিত।
গত ৩০ আগস্ট হজ পালনের জন্য দেশ ছাড়েন জাহিনের মা-বাবা। শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সন্তানকে শেষবারের মতো বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বাবা জহিরুল হক বলেন, ‘জানেন, বিদায় দেওয়ার সময় আমাকে ইহরামের কাপড় পরিয়ে দিয়েছিল জাহিন। খুব সিগারেট খেতাম বলে সেদিনই প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল সিগারেট ছাড়ার। কথাও দিয়েছিলাম। ঈদের দিন সকালে ফোনে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। তখন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, সেটাই হবে শেষ কথা।’
ছেলেকে হারিয়ে বিপর্যস্ত মা। প্রায়ই ভুলে যাচ্ছেন নির্মম সত্যটা। ভাবছেন, ছেলে বুঝি বাইরে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই ফিরবে। শুক্রবার বিকেলে বাসায় এই প্রতিবেদককে দেখে অভিমানী সুরে বলতে শুরু করেন, ‘আমার রায়াত (জাহিন) বাইরে গেছে। এখনো ফেরেনি। ফোনটাও সঙ্গে নেয়নি। কেন যে দেরি করছে ছেলেটা! আমরা হজ থেকে ফিরে এসেছি। রায়াতকে নিয়ে আবার হজে যাব।’ একটু থেমেই তিনি বলেন, ‘ওর পায়ে অনেক ব্যথা। ব্যথা নিয়ে কোথায় যে কী করছে!’ জাহিনের মায়ের অবস্থা দেখে উপস্থিত সবার চোখে তখন পানি। জাহিনের বন্ধুরা মিথ্যে সান্ত্বনা দেন নাফিসা হককে। বলেন, ‘রায়াতকে খবর দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে।’ একটু পরে জাহিনের বাবা এসে বুঝিয়ে জাহিনের মাকে নিজের কক্ষে নিয়ে যান।
জাহিনের পরিবারের সদস্যরা জানান, ৭ সেপ্টেম্বর ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রামে আসেন জাহিন। ২১ তারিখ ফিরে যাওয়ার কথা। ঈদের সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে দামপাড়ায় খালার বাসায় যান তিনি। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে বের হয়ে যান খালার বাসা থেকে। চার বন্ধু তখন অপেক্ষা করছিল এম এম আলী রোডের জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে। ওখানে এসে সবাই ঠিক করেন গোল পাহাড় মোড়ে যাবেন। শিল্পকলা একাডেমি থেকে গোলপাহাড় মোড়ের দূরত্ব এক শ গজ। অন্যরা হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পায়ে ব্যথা থাকায় রিকশায় চেপে বসেন জাহিন। সঙ্গে ওঠেন আরেক বন্ধু রায়হানুল। রিকশায় ওঠার পর ৫০ গজ এগোতেই উল্টো দিক থেকে আসা একটি প্রাডো গাড়ি সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে ছিটকে পড়েন জাহিন ও রায়হানুল। দৌড়ে এসে বন্ধু ও পথচারীরা দুজনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা জাহিনকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত রায়হানুল এখন নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে আছেন।
একটি দুর্ঘটনায় তছনছ হয়ে গেছে জহিরুল হক-নাফিসা হক দম্পতির সাজানো–গোছানো সংসার। সদা চঞ্চল ছোট ভাই আহনাফও আজকাল কারও সঙ্গে ভালো করে কথা বলছে না। ভাইয়ের মৃত্যুর আগের দিন ছিল আহনাফের জন্মদিন। মা-বাবা দূরে থাকলেও ছোট ভাইয়ের জন্মদিন ঘটা করেই পালন করেছিলেন জাহিন। কান্নাভেজা কণ্ঠে কিশোর আহনাফ বলে, আমার জন্মদিনের পরদিনই ভাইয়ার মৃত্যু দিন। আর কেউ আমার জন্ম দিনে গিটার বাজিয়ে গান শোনাবে না।
হজে যাওয়ার সময় জাহিনের দাদি আর খালা শামিমা রহমানের কাছে সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন মা নাফিসা। ফিরে এসে বড় সন্তানকে না পেয়ে এখন তাঁদের কাছে কেঁদে কেঁদে অনুযোগ জানাচ্ছেন। জাহিনের খালা বলেন, ‘শোক সইতে পারবে না বলে সৌদি আরবে আমার বোনকে বলেছিলাম জাহিন দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। ও তখনই আমাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল ও ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন আমি আইসিইউর দরজা থেকে সরে না যাই। আমাকে বলেছিল, আপা, আমার আমানত ফেরত দিবি। কিন্তু আমি পারিনি।’
দুর্ঘটনার রাতে গাড়িটি চালাচ্ছিলেন গাড়ির মালিকের ছেলে আবদুর রহমান জামি। পাশেই চালক বসা ছিলেন। চকবাজার থানায় এ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন জাহিনের খালা শামিমা রহমান। ওই রাতেই তাঁদের গাড়িসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বর্তমানে তাঁরা জামিনে আছেন।