দৃষ্টি ফিরে পেয়ে দুনিয়াটাকে কেমন দেখল জোনাকি

জোনাকি আক্তারের বয়স ১০ বছর। বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরে। মেয়েটার জন্ম হয়েছিল চোখের আলো ছাড়া। গত ১৭ জানুয়ারি তার চোখে লেন্স বসানো হয়েছে। এখন দেখতে পায় জোনাকি। তার কাছ থেকে চোখের আলোয় প্রথম পৃথিবী দেখার অভিজ্ঞতা শুনলাম আমরা

আমার একটা বিড়াল আছে। ওকে আমি মিনি বলে ডাকি। সে আমার অনেক দিনের বন্ধু। নাড়াচাড়া করলেই বুঝতে পারি ও ঘরের কোথায় আছে। দূরে থাকলে ‘মিনিইই’ বলে ডাক দিলেই আমার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু মিনি আমাকে দেখতে পেলেও, আমি ওকে কোনো দিন দেখিনি। ও দেখতে কেমন জানতামও না। আমার তো মনে হয়েছিল, এভাবেই হয়তো জীবনটা কেটে যাবে। কোনো দিন মিনিকে দেখব না। কিন্তু জাদুর মতো একটা ঘটনা ঘটে গেল। আমার চোখে লেন্স পরানো হলো। এখন আমি মিনিকে স্পষ্ট দেখতে পাই। আমরা গল্প করি!

জোনাকি এখন চোখের আলোয় বই পড়ে

তবে আমি প্রথম দেখেছি দাদিকে। তখন আমি হাসপাতালে। লেন্স পরানো হয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছিল। আমারও মনে সে কি ভীষণ আনন্দ। আবার ভয়ও, সত্যিই দেখতে পাব তো! নির্দিষ্ট সময় পর যখন আস্তে আস্তে চোখ খুললাম, দেখি সবকিছু কেমন আবছা আবছা। চোখে কালো চশমা পরা। আগে থেকেই দাদি আমার হাত ধরে বসে ছিলেন। চোখ খোলার পর দাদির দিকে তাকাই। এই প্রথম দাদিকে দেখা। আমি যখন একদম ছোট, বাবাকে ছেড়ে চলে যান আমার মা। দাদির কাছেই আমি বড় হয়েছি। তবু কণ্ঠ ছাড়া দাদি সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ আমার কাছে। তখন আমার চারপাশের সবকিছু সুন্দর লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আমি স্বপ্ন দেখছি। দাদিকে দেখার পর বাবাকে দেখলাম। যে বাবাকে শুধু কল্পনা করতাম, স্পর্শে চিনতাম, সেই বাবা আমার সামনে নতুন রূপে তখন।

দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার পর আর হাসপাতালে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। মনে হচ্ছিল কখন বাড়ি যাব। কখন মিনির সঙ্গে দেখা হবে। আরও যারা আমার কাছের মানুষ, তাদের দেখব। আমাদের বাড়িটাও দেখব।

হাসপাতাল থেকে আমাদের বিদায় দিল। সাদ্দাম হোসেন চাচার গাড়িতে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। আমার বাবার তো অত টাকা নেই, সাদ্দাম চাচাই আমার চিকিৎসা করিয়েছেন। আমি দেখতে পাচ্ছি দেখে তিনিও অনেক খুশি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঢাকা দেখলাম। বাস, বিল্ডিং, রিকশা, মানুষ—সবকিছুই আমার কাছে নতুন।

দাদির সঙ্গে জোনাকি

একসময় আমরা বাড়ি পৌঁছাই। বাড়ির উঠান, গাছপালা ঘুরে ঘুরে দেখি। নতুন পৃথিবী। এ অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়। ততক্ষণে আমার মিনি দৌড়ে কাছে এসেছে। মনে হচ্ছিল সেও যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আশপাশের কত মানুষ যে আমাকে দেখতে এলেন। তাঁদের অনেকের কণ্ঠ আমার পরিচিত, এই প্রথম দেখা। এসে এসে বলছিলেন, আমি ‘অমুক’, আমি ‘তমুক’। কথা বললে বুঝতে পারি তিনি কে।

সাদ্দাম হোসেন
জোনাকির চোখের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাদ্দাম হোসেন। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুরের নগরহাওলা গ্রামের মানুষ। পেশায় ব্যবসায়ী। চিকিৎসা সহযোগিতার বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘একদিন জোনাকিদের বাড়ি গিয়েছিলাম তাদের সবাইকে দেখতে। সেদিন জোনাকির বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা দেখে আমার ভীষণ মায়া হয়। মনে হলো, মেয়েটার সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ, যদি কিছু করা যায়।’ জোনাকির অন্ধত্ব নিয়ে পরিচিত এক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন সাদ্দাম হোসেন। জানতে পারেন, জন্মান্ধ হলেও চিকিৎসার পর অনেকেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। সে আশায় ঢাকায় বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। অবশেষে তার চোখে কৃত্রিম লেন্স স্থাপন করা হলো। সাদ্দাম বলেন, ‘মেয়েটা এখন এক চোখে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে। অন্য চোখেও শিগগিরই অস্ত্রোপচার হবে। তার পাশে থাকায় আমার স্বার্থ নেই, তৃপ্তি আছে।’

ডাক্তার লেন্স বসানোর পর কালো চশমা পরিয়ে দিয়েছিলেন। বলে দিয়েছেন, যখন-তখন চশমা খোলা যাবে না। চশমা পরে চারপাশটা ঠিক ভালোমতো দেখতে পেতাম না। বাড়ি ফিরে মাঝেমধ্যে চশমা খুলে চারপাশটা দেখতে ইচ্ছা হতো, দেখতাম। দিনকে দিন চোখে আরও স্পষ্ট দেখতে পারছি। আগে উঠান থেকে ঘরে যেতে দাদিকে ডাকতে হতো অথবা রান্নাঘরের খুঁটি কিংবা বেড়ায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যেতাম। অনুমান করে পথ চলতাম। এখন একা সহজেই চলাচল করতে পারছি।

মনের আলোয় নয়, জোনাকি আক্তার এখন পৃথিবী দেখে চোখের আলোয়

চোখে দেখা শুরুর পর আমার স্বপ্ন দেখাও যেন শুরু হয়েছে। ইচ্ছা করে বই পড়তে, ঘরের বাইরে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে খেলতে। দশটা মানুষ যেভাবে কাজ করে, যেভাবে ঘুরে বেড়ায়, আমারও তা-ই করতে ইচ্ছা করে।

বাবা আর সাদ্দাম চাচা বলেছেন, আমাকে তাঁরা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবেন। তার আগে অন্য চোখেও লেন্স বসানো হবে। আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, কবে অন্য চোখেও দেখতে পাব, কবে স্কুলে যাব। আমি মক্তবে পড়েছি। এখন স্কুলে গিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করব। আমি যে চোখের ডাক্তার হতে চাই।