
একটু খেয়ালি স্বভাবের কামরুল (রবিউল করিম) ভাই মাঝেমধ্যেই পরিবারের সদস্যদের ভাবনায় ফেলে দিতেন। নানা রকম খেয়াল তাঁর মাথায় ভর করত। কলেজে পড়ার সময় হঠাৎ তাঁর ইচ্ছে হলো গান শিখবেন। মায়ের কাছে হারমোনিয়াম কেনার বায়না ধরলেন। বাবার পীড়াপীড়িতে শেষমেশ মা পূরণ করলেন বায়না। তারপর মহা উৎসাহে লেগে গেলেন পাশের বাড়ির দেলোয়ার কাকার কাছে হারমোনিয়াম বাজানো শেখায়। পাশাপাশি স্বাধীনতা, বাংলার রূপ নিয়ে লিখে ফেললেন বেশ কয়েকটি গানও। তারপর ঝোঁক চাপল বাউল হওয়ার। লিখলেন কবিতা। ‘মাঠের মাঝে ফসল রে ভাই ঘাটের মাঝে ভেলা; বাংলার রূপ দেখতে দেখতে কেটে যায় যে বেলা’। বাড়ির উঠানে সন্ধ্যারাতে গানের আসর জমাতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হঠাৎ তাঁর সাধ জাগে কৃষক হওয়ার। বন্ধু মিজানুর রহমানকে নিয়ে গ্রামে গিয়ে লিজ নেন বেশ কিছু ধানি জমি, পুকুর। ধান, ভুট্টা, মাছ চাষের পাশাপাশি ফুলের বাগানও করেন। সেই ফুল বিক্রি করতে চলে যেতেন ফার্মগেটে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর শিক্ষাজীবন নিয়ে ভাবনায় পড়ে যান মা-বাবা। মাকে ভাইয়া সান্ত্বনা দিতন, ‘সৎ-সাদামাটা জীবনের চাইতে ভালো উপায় আর কী আছে, বলো।’ মা তাঁর কথা শুনে আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়তেন। বলতেন, ‘খোদা তোমাকে বুঝ দিক, বাবা।’ ভাইয়া মাকে হতাশ করেননি। সব দুর্ভাবনা মিথ্যা প্রমাণ করে তিনি পড়ালেখা শেষ করেন সাফল্যের সঙ্গে।
২০০৬ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন। যেকোনো বিপদে সব সময় তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘কোনো চিন্তা করবি না। আমি আছি না।’ ভাইয়া ফোনে শুধু জানতে চাইতেন, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছি কি না। বলতেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, আমাকে শুধু একটু সময় দে।’ শুনে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মাথা নত হয়ে যেত আমার। সব সময় আমার পক্ষ নিয়েই কথা বলতেন ভাইয়া। সব দায়িত্ব যেন তাঁর একার।
কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন শেষে সুযোগ পেলেই চলে যেতেন গ্রামে। মাঝেমধ্যে আমাকেও বলতেন, ‘বাড়ি যাবি না, চল বাড়ি যাই।’ আমি দুষ্টুমি করে বলতাম, ‘আপনি তো অন্যদের ঝামেলা সমাধান করতে যাবেন।’ ভাইয়া বলতেন, ‘ওদের আর যাওয়ার জায়গা কই?’
ভাইয়ার ছেলে সাজিদুল করিমকে শহরের কোেনা ভালো স্কুলে ভর্তি করাবেন, এই নিয়ে আমার সঙ্গে ভাইয়ার মতের মিল হতো না। তবে তাঁর যুক্তি আমাকে পরাজিত করত বরাবরই। ভাইয়ার মতে, তাঁর গড়ে তোলা নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি স্কুলেই গ্রামের অন্য সাধারণ শিশুদের মধ্যে ছেলের প্রকৃত বিকাশ সম্ভব। সেখানে সকল স্তরের শিশুর সঙ্গে মেশা যায়। সে কারণে সেখানেই দাম্ভিকতা পরিহারের সুযোগ বেশি। নিজে সময় পেলেই চলে যেতেন প্রতিবন্ধীদের জন্য গড়ে তোলা স্কুলে ক্লাস নিতে। পড়াতেন খেলার ছলে। সেখানে ‘বড় স্যার’ হিসেবেই শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিতি ছিল তাঁর।
মাটির একটি ছোট্ট ব্যাংকে টাকা জমাতেন ভাইয়া। ইচ্ছা ছিল ব্যাংকটি পূর্ণ হলে সেটি খরচ করবেন নিজের গড়া স্কুলের জন্য। কিন্তু ভাইয়ার সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। মাটির সামান্য ব্যাংকটিই আজ অসামান্য হয়ে উঠেছে তাঁর স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে। গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা মানুষটি যেন তাঁর ঋণ শোধ করতে চেয়েছেন সব সময়। স্বাপ্নিক মানুষটির সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানামুখী কাজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মানিকগঞ্জের কাটি গ্রামে।
মানবসেবার ব্রত নিয়ে ভাইয়া যে কাজ শুরু করেছিলেন, সেটাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। ভাইয়া, তোমার দেখানো পথই হবে আমাদের চলার পথ। তুমি ভালো থেকো ওপারে।
লেখক: হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহত মহানগর পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র সহকারী কমিশনার রবিউল করিমের ভাই।