
রুমি আপার দৃঢ়বিশ্বাস, কোরবানির গরুটা আমাদের মিনকাই। হেলাফেলা করে তাকে উড়িয়ে দিতে চাইলাম। ‘কোনকালে বেচে দেওয়া ছয় মাসের ছোট্ট বাছুর—মিনকা হতে যাবে কেন? দূর!’ রুমি আপা প্রমাণ করতে লাগলেন যে গরুটা তাঁকে ঢুস মারে না!
‘না মারতেই পারে, কত গরুই তো গোবেচারাই হয়।’
মিনকার গায়ের কোথায় সাদা দাগ ছিল, কপালে সামান্য লাল ছিল—সে মনে করিয়ে দিতে লাগল। ‘মুখ থেকে খড়ের ডালি সরিয়ে নিলে ঢুস মারতে মারতে মাকে দরজার বাইরে ফেলে এসেছিল, মনে নাই? অথচ দেখ, আমাকে মারছে না!’ চার বছর আগে বেচে দেওয়া সামান্য বাছুর এত দিন পর তাকে নাকি চিনতে পেরেছে!
অস্ট্রেলিয়ান গাভির বকনা বাছুর ভালো দাম পাওয়া যায়—প্রতিবেশী জাব্বার বলছিল। ‘বাঁচ্যা আছে এই মেলা’ মরে যাওয়া বাছুরের জন্য আব্বা আফসোস করে। প্রথম বাছুরটা এক দিনও বাঁচেনি। বাইরে এক হাতও মাটি নাই আমাদের। বাছুরটাকে বাড়ির আমগাছটার গোড়ায় পুঁতে দিয়েছিলাম। সবাই কেঁদেছি। অভাবের সংসারে মানুষের চেয়ে গরুর দাম কম কিসে?
চোখের সামনে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেল পুরো এলাকা। মানুষ খড়খুটোর মতো ভেসে গেল। যে যেখানে পারল, পালাল। নাচোল পালাল বেশির ভাগ মানুষ। যারা এ দেশে থাকার কোনো মানে দেখল না তারা পালাল চরে। আমরা রামচন্দ্রপুর হাটে। আব্বার চাকরি এখানে। অবস্থা বেগতিক দেখে তিন কাঠা জমি কিনে রেখেছিল আব্বা। পদ্মা কাউকে বাপের ভিটায় থাকতে দেয়নি।
পাঁচিল উঠিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজা হলো। বাড়িটা সহজে চেনা যায়। ‘অমুকের বাড়ি কোনটা?’ চিনিয়ে দেওয়া এক আঙুলের ব্যাপার—‘ওই যে ভাঙা বাড়িটা।’
‘ঝাড়া হাত-পা লিয়া বস্যা থাকা যায় জি? টাইম কাটে না’—মা একটা বকনা কেনার আবদার করে। ‘লাদি-ঘুষিটাও হবে। লকড়ি-খড়ির যা দাম। কপাল ভালো হলে দুপয়সা হতে পারে।’
‘গরু পুষব্যা—জাগা আছে? থুব্যা কণ্ঠে? আল্যা জাগা থাকলে নাহয় হয়’—আব্বা ভেটো দেয়।
সারা জীবন গরুর দেখাশোনা করেছেন, এখন মায়ের বসে বসে সময় কাটে না। যেহেতু টাকাটা মা দেবে, আব্বার না করার জো থাকে না।
কপাল মন্দ—গরুটা দেশি ছিল না। ‘এক দেশ থাক্যা আরেক দেশ আসছ্যে—দু-চার দিন পরে ঠিকই খাব্যে’, আব্বা মাকে বোঝায়। গরুটা না খেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। টেনশনে পড়ে গেলাম। ‘হাতে ধর্যা আপরুব কিনতে গেনু’—আব্বা আবার বেচে দিতে চায়!
দুটা মাস দেখি—মা রিকোয়েস্ট করে।
বকনাটা গাভিন হয়! লাল বাছুরটা বাঁচে না। পরের দিনই মরে গেছে।
আব্বা দিনরাত টেনশন করে। রুমি আপার বয়স হয়ে যাচ্ছে। পিঠাপিঠি ভাই ফেরদৌস ইন্টারে পড়ে। আমার ছোট বোন খালেদা সেও মাথায় সমান।
মেয়ে পছন্দ হয়—বিয়ে হয় না। পাত্রপক্ষ বিষয়-সম্পত্তির খোঁজ নেয়। পদ্মায় ডোবা জমির দাম নাই। ‘টাকার মোথলা লাগবে’—মা চিন্তা করে কূল-কিনারা পায় না।
রুমি আপা নিজেকে অপরাধী ভাবে। বিয়ে ঘুরে যায় তার, সুতরাং দোষটা তার! সে বিরক্ত হয়ে ওঠে।
‘গরু দেখার মতো করে দেখাও। সস্তায় ফেলে দিলেই তো পারো।’
গাভিটা আবার বাচ্চা দেয়। বাছুরটা নাদুসনুদুস হয়েছে। কালোর মধ্যে পায়ের নিচে সাদা। কপালে সাদা আর সামান্য লাল। রুমি আপা নাম রাখে মিনকা! মোটেই ভেবেচিন্তে রাখা নয়। নিজেও তার মানে জানে না।
সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়ে বাসায় ঢুকছি। ‘তাড়াতাড়ি তোর বড় ভাইকে খবর দে বেটা, রোমিশার বিহা।’ ‘দূর!’ আসতে না-আসতে আবার নবাবগঞ্জ!
ফিরে এসে দেখি রুমি আপার বিয়ে হয়ে গেছে। ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে দেবে দেবে। দাদা আর আমি বিয়ে মিস করলাম।
ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলো না। স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে মাত্র তিন দিন হলো জয়েন করেছে। এক লাখ টাকা ঘুষ লেগেছে। ওটা আমাদের দিতে হবে!
যৌতুকের টাকা নিয়ে আবার দুশ্চিন্তা শুরু হয়। চড়া সুদে টাকাটা ধার করে দেওয়া হয়েছে। সব কিছু ম্যানেজ করেছে জিয়া দাদা।
যেভাবই হোক, টাকাটা জোগাড় করা লাগবে। গরু-বাছুর বেচে দেওয়া হলো। মাত্র ১৩ হাজার টাকা। মিনকার জন্য কাঁদলাম।
চার বছর গত হয়েছে। সন্তানসম্ভবা রুমি আপা আমাদের বাড়িতে।
গরুটাকে নিশ্চিতভাবে মিনকা বলে ধরে নেয় সে। আমারও কিছুটা ভ্রম হয়। তবু ভুংভাং বোঝাতে চাইলাম। কিছুতেই তার সন্দেহ ঘোচে না।
রামচন্দ্রপুর হাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।