গল্প

স্নান

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

বিচের এই দিকটায় লোকজন আসে না। দিনের বেলাতেও থমথম করে। বহু খুঁজে খুঁজে এই জায়গাটা পেয়েছে সে। নিষিদ্ধ জায়গা। অনেকটা তারই মতো। বিকেলের নরম আলোয় স্নানরতরা যখন সুখ এলিয়ে সমুদ্রের জলে বসে থাকে, তাদের চোখের সাম​েন দিয়ে হেঁটে এদিকটায় এসেছে মিশরী। কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। অবশ্য কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতো গুরুত্ব সে আশাও করে না।

আকাশে পূর্ণিমার হলুদ চাঁদ অনর্থক আলো ছড়িয়ে রেখেছে। আলোকে বড় ভয় করে মিশরী। কৈশোর থেকে অন্ধকারটাই আপন করে নিয়েছে তাকে। বাবা-মার কথা মনে পড়ে না তার। খুব কি ছোট ছিল সে? আট বছর বয়সের স্মৃতি কি এত পরিষ্কারভাবেই মুছে যায়? ঠিক কবে নিজের জন্মদাতা-জন্মদাত্রীকে ভুলে গেছে তা সে নিজেও জানে না। পরিবার বলতে এক মামাবাড়ি ছিল সব। মামা-মামির কঠোর শাসনে কাটানো শৈশব-কৈশোর নিয়ে এখন আর খুব একটা আক্ষেপ নেই তার মনে। ওনারা ছিলেন বলেই হয়তো এই তিন অক্ষরের নামটা ২৮ বছর ধরে পৃথিবীর জল-হাওয়া কলুষিত করছে।

যাক সেসব কথা। মিশরী তার ঘন নীল শাড়িটির দিকে তাকায়। মেসে থাকাকালে টিউশনির টাকা জমিয়ে অনেক শখের এই শাড়িটি কিনেছিল সে। শিহাব খুব পছন্দ করত নীল রং। প্রথমবার নীল শাড়ি পরে তাই শিহাবের সামনে দাঁড়িয়েছিল। রাঙা হয়ে ওঠা মিশরীর হাত ধরে মেলায় ঘুরে ঘুরে নীল চুড়ি আর বেলি ফুলের মালা কিনে দিয়েছিল। চোখ দুটো বড় সুন্দর ছিল শিহাবের।

না, রুবার মতো তার বিশ্বাস ভাঙেনি শিহাব। রুবা তো সবার সামনে তার কথাগুলো নিয়ে রসিয়ে ঠাট্টা করেছিল। শিহাব কোনো কষ্ট দেয়নি মিশরীকে। শুধু আলতো করে তার মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিল। কিছু বলতে হয়নি। তারপর যতবার যার কাছেই একটু আশ্রয় পেতে চেয়েছে, সবাই শুধু নিজের তৃপ্তিটুকু ছেঁকে নিয়ে ছুড়ে ফেলেছে তাকে। মিশরীর মতো সরকারি বস্তুকে শেষমেশ মূল্য দিয়েছে কক্সবাজারের এই আবাসিক হোটেল।

শিহাবের হাতে হাত ধরে ধানখেতের পাশে হেঁটে বেড়ানো সময়গুলোতে আগুনের মতো সুন্দরী ছিল মিশরী। আর এখন আয়নায় নিজেকে দেখতে ভয় করে তার।

গত সাত দিন সে উপার্জনহীন। এই সাত দিনে সে কোনো মিথ্যে বলেনি, কাউকে ধোঁকা দেয়নি, কারও বিছানায় এলিয়ে দেয়নি নিজেকে।

 এবার একটু আলো চায় সে। তাই জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো নীল শাড়ি পরে এই নির্জন জোছনায় বসে সূর্য ওঠার অপেক্ষা করছে। ভোরের আলো তার জীবনের তিক্ততাকেই স্পষ্ট করেছে বারবার। আজ তাই সেই আলোর কাছেই সব তিক্ততার জলাঞ্জলি দেবে সে।

 ‘যদি একজন মানুষও শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নিঃস্বার্থভাবে একটু হাসত, তবে আমি অনন্তকাল এ জীবনের ভার বয়ে বেড়ানোর মতো দুঃসাহস করতাম।’

আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। মিশরীর গায়ে আলো এসে পড়ছে। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল এক আলোকিত গভীর স্নানের জন্য।