হাত ধরে হাতেখড়ি

২০১৬ সালে প্রথম আলোর বর্ণমেলায় অভিনেতা ও শিল্পী আফজাল হোসেনের কাছ থেকে হাতেখড়ি নিচ্ছে এক শিশু। ছবি: প্রথম আলো
২০১৬ সালে প্রথম আলোর বর্ণমেলায় অভিনেতা ও শিল্পী আফজাল হোসেনের কাছ থেকে হাতেখড়ি নিচ্ছে এক শিশু। ছবি: প্রথম আলো

ধরুন, আপনার বন্ধুটি দারুণ একটি জিনিস দেখাবে বলে আপনাকে ডেকে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। ‘গোপনীয়’ কিছুর স্পর্শ পেতে যাচ্ছেন ভেবে আপনি বেশ পুলকিত। বন্ধুটি তার শোয়ার ঘরের আলমারি খুলল, বের করল সযত্নে রাখা একটি ফাইল। তারপর আপনার বিস্মিত চোখের সামনে মেলে ধরল একটি কাগজ। সে কাগজে কাঁচা হাতের লেখা একটি ‘অ’ অক্ষর। তার নিচে হয়তো শিল্পী কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী কিংবা কবি শামসুর রাহমানের নাম!
আপনি কিছুটা দ্বিধান্বিত। ভাবছেন, হঠাৎ ‘অ’ কেন। বিখ্যাত ব্যক্তির নামই বা কেন অক্ষরটির নিচে?
নানা উত্তরও মাথায় আসছে আপনার। সম্ভবত ঠিক উত্তরটি থেকেও আপনি দূরে নন। বললেন, ‘তোমার “হাতেখড়ি” হয়েছিল?’
বন্ধুটি মাথা নাড়বে। তারপর খুলে যাবে তার মুখ। সে বলতে থাকবে সেই সময়টার কথা, যা তার স্মৃতিতে ক্ষীণ দোলা দিয়ে যায়। বেশি করে বলবে সেই মানুষের কথা, যাঁর নাম লেখা আছে অক্ষরের নিচে!
ব্যাপারটা সত্যিই দারুণ। ছোট্ট একটা হাত জড়িয়ে ধরেছে একজন বর্ষীয়ান মানুষের হাত। তারপর একটি সাদা কাগজে লেখা হচ্ছে প্রথম অক্ষর। তারপর দিনটি হয়ে যাচ্ছে জীবনের প্রথম পাঠ।
হাজার বছরের ঐতিহ্য আমাদের এই হাতেখড়ি অনুষ্ঠান। বাদশাহ আকবরের আমলেও মুসলমানদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল, ‘তাক্তি’ নামে। এখন অবশ্য বাঙালি জীবনে হাতেখড়ি নামটাই গৃহীত হয়েছে। গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় এ অনুষ্ঠানটির কদর ছিল। এখন শহুরে মানুষও হাতেখড়ি অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে স্মৃতিকে স্বর্ণালি করে রাখার কথা ভাবছেন। অনেকেই বলবেন, আমি তো জানি, শ্লেট আর খড়িমাটি হাতেখড়ির প্রধান অনুষঙ্গ। খুব সত্যি কথা। সেটাই ছিল ঐতিহ্য অনুযায়ী। এখন অবশ্য তা বদলে যাচ্ছে। সব ঐতিহ্য ধরে রাখাও যায় না। জাতীয় হাতেখড়ি পর্ষদের সভাপতি কামাল লোহানী বলছিলেন, ‘আগে তো এ দিন সোনার আংটি দেওয়া, নতুন কাপড় দেওয়ার চল ছিল। চল ছিল পায়েস খাওয়ানোর। কিন্তু এখন ঢাকা শহরে ১০ বছর ধরে আমরা যে হাতেখড়ি অনুষ্ঠানটি করছি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, তাতে শিশুদের জন্য ওসবের ব্যবস্থা না থাকলেও মুড়ি-মুড়কি, চকলেটের ব্যবস্থা থাকে। থাকে একটি সনদ। তাতেই শিশুটি তার প্রথম অক্ষরটি লেখে। সমাজের একজন মানী-গুণী মানুষ তার হাত ধরে অক্ষরটি লেখান। তারপর তিনি সে সনদে দিয়ে দেন তাঁর স্বাক্ষর। আর সভাপতি হিসেবে আমার স্বাক্ষরটাও থাকে। শিশুটি বড় হয়ে সনদটি দেখে নিজের প্রথম অক্ষর লেখার দিনটি স্মরণ করতে পারে।’
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম শুক্রবার হাতেখড়ি পরিষদের আয়োজনে হাতেখড়ি অনুষ্ঠানটি হয়।

বরেণ্য শিল্পী ফরিদা জামান ও আবদুল মান্নানের হাতে শিশুদের হাতেখড়ি

আর ২১ ফেব্রুয়ারির দিন প্রথম আলো আয়োজিত বর্ণমেলায়ও থাকে হাতেখড়ি উৎসব। এদিনও গুণী মানুষের কাছে অক্ষর লেখার দীক্ষা নেয় শিশুরা। এ বছরও সার্ফ এক্সেলের সহযোগিতায় ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ মাঠে আজ দিনব্যাপী প্রথম আলোর বর্ণমেলা অনুষ্ঠানে থাকবে হাতেখড়ির আয়োজন। সেটা শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে অনুষ্ঠেয় বর্ণমেলায়ও থাকবে হাতেখড়ি।
যদি বড় অনুষ্ঠানগুলোয় হাতেখড়ি দেওয়ানো না যায়, তাহলে কি হতাশ হয়ে বসে থাকবেন? মোটেই না। আপনি নিজের পরিবারের মধ্যেই বর্ষীয়ান মানুষটাকে অনুরোধ করুন, সন্তানের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি হতে। তিনি নিজে যেমন তাতে গর্ববোধ করবেন, তেমনি এই শিশুটিও যখন বড় হয়ে তার অতিপ্রিয় গুরুজনের স্বাক্ষর দেখতে পাবে তার লেখা প্রথম অক্ষরের সঙ্গে, সে-ও নিজেকে ভাগ্যবান বলে মেনে নেবে।
হাতেখড়ি জীবনের প্রথম বাঁক। এখান থেকেই শুরু হতে পারে স্বাক্ষর চলাফেরা। হাতেখড়ির দিনটিকে আনন্দময় করে তুলুন জীবনের প্রথম পাঠের স্মৃতি হিসেবে। দেখবেন, ভালো লাগবে।