
ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়ই অভাবটা ভালোভাবে টের পান রায়হান উল ইসলাম। প্রস্তুতি নেওয়ার বহু উপকরণ আছে ঠিক, কিন্তু নিজের ভুল ধরার বা নিজ গতিতে শেখার মতো কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। এই অভাব দূর করতেই রায়হান তৈরি করেন একটি অ্যাপ—চর্চা। স্কুলজীবন থেকেই কোডিংয়ের সঙ্গে সখ্য ছিল, তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী ‘চর্চা’ ব্যবহার করতে শুরু করে। তারপর?
রায়হান বলেন, ‘সত্যি বলতে, রুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর আরও সাহস পেয়েছি। শুরুর দিকের ক্লাসগুলোয় বন্ধুরা যখন বলত, “চর্চা তোদের প্ল্যাটফর্ম? আমি নিজেই তো চর্চা ইউজ করে অ্যাডমিশনের প্রিপারেশন নিয়েছি!” শুনে ভীষণ ভালো লাগত। মনে হতো সত্যিই অর্থপূর্ণ কিছু করতে পেরেছি।’
কিন্তু বড় পরিসরে কিছু করতে গেলে একা পেরে ওঠা কঠিন। এমনিতেই প্রথম দিকের ল্যাব, ক্লাস, রাত জেগে কোড লেখা, হুটহাট সার্ভার বন্ধ হয়ে যাওয়া—এসব নিয়ে এলোমেলো সময় কাটাচ্ছিলেন রায়হান। সংগ্রামের এই দিনগুলোয় পাশে পেলেন একই বিভাগের সহপাঠী নাফিস রায়হানকে। কোড, ডিজাইন, কনটেন্ট—সব ঢেলে সাজাতে শুরু করেন দুজন। রায়হানরা প্রথম বর্ষ পেরোতে পেরোতেই চর্চার ডাউনলোড ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়।
মোটামুটি একটা দল দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর দ্রুত বদলে যেতে থাকে চর্চা। প্র্যাকটিস সেট, দুর্বলতা বিশ্লেষণ, টাইম কুইজ, সিলেবাসভিত্তিক কনসেপ্ট ইত্যাদি এমনভাবে সাজানো হয় যেন শিক্ষার্থী নিজের সুবিধামতো শিখতে পারে। ধীরে ধীরে ডাউনলোডের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৭ লাখে পৌঁছায়।
কিন্তু এরপরই আচমকা ধাক্কা। গত নভেম্বর মাসে কোনো নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ চর্চা অ্যাপটি সরিয়ে দেয় গুগল প্লে স্টোর। রায়হান বলেন, ‘স্ক্রিনে অ্যাপটা নেই দেখে মনে হয়েছিল বুকের ভেতর কিছু ভেঙে যাচ্ছে। এত বছরের পরিশ্রম শেষ হয়ে গেল! সবাই কি আমাদের ভুলে যাবে?’ কিন্তু যা হওয়ার কথা ছিল, হলো তার উল্টো! হাজারো শিক্ষার্থী চর্চা খুঁজতে শুরু করল। ফেসবুকে বিভিন্ন জায়গায় পোস্ট করল, গ্রুপে লিখল—‘চর্চা কোথায়?’, ‘ফিরে আসুক’, ‘অ্যাপ ছাড়া প্র্যাকটিস হচ্ছে না’।
টানা ১০ দিনের নানা চেষ্টার পরও ফেরত আনা গেল না। অতএব নতুন করে অ্যাপ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন দলের সবাই। ব্যবহারকারীদের সাড়াও পাওয়া গেল বেশ। রায়হান বলেন, ‘ইউজাররাই আমাদের অনেক বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন। হাজারো পোস্ট, কমেন্ট এবং অনুপ্রেরণার পাশাপাশি তারা নিজেরাই ফেসবুকে #SupportChorcha, #InstallChorcha লিখতে শুরু করে। এ ছাড়া এডটেক ইন্ডাস্ট্রির অনেক সিনিয়র আমাদের সাপোর্ট করে তাদের পেজ ও গ্রুপে পোস্ট করেন। সবার সহায়তাতেই এক সপ্তাহে চর্চার নতুন অ্যাপ এক লাখের বেশি ইনস্টল হয়ে যায়।’
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বোঝা কমানোর লক্ষ্য নিয়ে চর্চার যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেখার প্রতিটি ধাপকে আরও ব্যক্তিগত, আরও মজার, আরও কার্যকর করার ইচ্ছে ছিল। ঠিক এই ভাবনা থেকে জন্ম নেয় চর্চা এআই। এটি শুধু একটি সহায়ক টুল নয়, বরং শিক্ষার্থীর ‘পারসোনালাইজড লার্নিং সলিউশন’। উদ্যোক্তারা বলছেন, চর্চা এআইকে পাঠ্যবই এবং ১০ লাখের বেশি প্রশ্নের তথ্যভান্ডার দিয়ে ‘প্রশিক্ষণ’ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী চাইলে যেকোনো প্রশ্ন ছবি বা লেখা আকারে দেখাতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের রেফারেন্সসহ উত্তর দিয়ে দেয় চর্চা এআই। কোন কোন বিষয়ে দুর্বলতা আছে, কোথায় আরও অনুশীলন প্রয়োজন, শেখার অগ্রগতি কতটা হলো, এসবও দেখা যায়।
চর্চাকে শুধু পরীক্ষা প্রস্তুতির সীমায় আবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীদের শেখার পুরো অভিজ্ঞতাকে সহজ, মজার ও ফলপ্রসূ করে তুলতে চান রায়হান ও তাঁর দলের সদস্যরা। করতে চান একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম। রায়হান বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা চর্চাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত লার্নিং অ্যাপ হিসেবে দেখতে চাই। আমাদের স্বপ্ন খুবই পরিষ্কার—বাংলাদেশ থেকে জন্ম নেওয়া একটি প্ল্যাটফর্ম যেন বিশ্বজুড়ে কোটি শিক্ষার্থীর শেখার সঙ্গী হয়, যেখানে তারা নিজের মতো করে চর্চা করবে।’