আমাদের পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য টুকি। পাঁচ মাস ধরে সে-ই বাসার সবচেয়ে আদুরে সদস্য। টুকি আমাদের বিড়ালের নাম। বয়স আট মাস। বলা যায়, তাকে কেন্দ্র করেই সবার বড় একটা সময় কাটে। আমার মা ও বোন টুকিকে ঠিক ছোট্ট শিশুর মতোই খেয়াল রাখে। বাবা করে খুনসুটি।
পরিবারের সবাই মিলে এর মধ্যে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। যৌথ পরিবারসমেত ঘুরতে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ছোটদের কেউ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, বড়দের আছে চাকরি। একই সঙ্গে সবার ছুটি মেলানো তাই বেশ কঠিন। তবু অনেক দিন ধরেই চলছিল পরিকল্পনা। অবশেষে ঘুরতে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিকঠাক হলো। তবে চিন্তায় ফেলল টুকি। বাসায় রেখে যাওয়া যাবে না। পাশের বাসায় রাখার প্রস্তাব করার সাহসও পেলাম না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, টুকিও আমাদের সঙ্গে সিলেট ভ্রমণে যাবে।
কিন্তু কীভাবে নেব? ‘ক্যারিয়ার’ কোন ধরনের হবে? প্রস্রাব-পায়খানার ব্যবস্থা কী? কেমন খাবার খাওয়াব?
আস্তে আস্তে সব প্রস্তুতিই নিলাম। এই ভ্রমণকে মাথায় রেখেই বিড়াল বহন করার পিঠে ঝোলানো ব্যাগ (ব্যাকপ্যাক) কিনেছি। স্কুলব্যাগের মতো দেখতে এসব ব্যাগের সামনের অংশটি স্বচ্ছ। ফলে বিড়াল সহজেই দেখতে পারে, ভয় কম পায়। সংগ্রহে ছিল বিড়ালের শুকনা ও ভেজা খাবার। একটি লিটার বক্স ও পর্যাপ্ত লিটারও ব্যাগে নিয়েছি।
এটাই টুকির প্রথম ভ্রমণ। মাইক্রোতে উঠেই বারবার মিউ মিউ করছিল। একপর্যায়ে ব্যাগ থেকে বের করে কোলে নিলে কিছুটা শান্ত হয়। পরের পর্ব রেলযাত্রা। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে আমরা সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করি। প্রথম দিকে ট্রেনের শব্দে টুকি বেশ ভয় পাচ্ছিল। আতঙ্কিত হয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল ও হাঁপাচ্ছিল। পানি বা খাবারও খাওয়ানো যায়নি। তাই কিছুটা ভয় পাচ্ছিলাম।
তবে তিন–চার ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সেতুতে ট্রেন উঠলে শব্দ হয় বেশি। তখন সে ভয়ে কয়েকবার কোল থেকে নেমে যেতে চেয়েছে। তবে হারনেস থাকায় নাগালের বাইরে যেতে পারেনি।
সিলেটে আমাদের নির্ধারিত গেস্টহাউসে পৌঁছানোর পর আবার শান্ত হয়ে যায় টুকি।
ভয় পেয়ে কামড়–আঁচড়
পরদিন সকালে উঠেই রওনা হই রাতারগুল। জলাবনে যাওয়ার সময় বিড়ালটি সবার কোলে ছিল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতেও সে হাঁপিয়েছে। একপর্যায়ে বিড়ালের মাথায় হালকা পানি দিয়ে মুছে দেওয়ায় কিছুটা স্বস্তিবোধ করে।
রাতারগুলের নৌকাভ্রমণ সে উপভোগ করেছে। তবে গরমে কষ্ট পেয়েছে। এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। মূল স্পটে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে হবে। বিড়ালকে কোলে নিয়েই আমরা নৌকায় বসি। তবে ইঞ্জিন চালু করতেই জোরালো শব্দে আতঙ্কিত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি শুরু করে টুকি। হারনেস ছেড়ে দিলে নির্ঘাত পানিতে পড়বে। তাই ওকে শান্ত করার চেষ্টা করি। এর মধ্যেই সে আমার হাত, গাল এবং বোনের হাতে কামড় ও আঁচড় দেয়। কোনো রকমে ক্যারিয়ার ব্যাগে আবদ্ধ করা সম্ভব হয়। ইতিমধ্যে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে।
টিসুপেপার দিয়ে চেপে ধরে সাদাপাথরে পৌঁছাই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, এত জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। তৎক্ষণাৎ ফোনে ভেটেরিনারি চিকিৎসক বন্ধুর পরামর্শ নিই। সে জানায়, বিড়ালের যেহেতু ভ্যাকসিন দেওয়া আছে, তাই আমাদের আর ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ক্ষতস্থান ভায়োডিন দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
ভায়োডিনের জন্য ৩০ মিনিটেরও বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। আপাতত তাই ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করি। পরে সিলেট শহরে গিয়ে ভায়োডিনের সাহায্যে আবারও ক্ষতস্থান পরিষ্কার করি।
পরের দিন আর বিড়ালকে সঙ্গে নেওয়ার সাহস করিনি। এমনিতেই প্রচণ্ড গরম, তার ওপর জাফলংয়েও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ভ্রমণ করতে হবে। তাই ঘরেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে খাবার ও লিটার বক্সের ব্যবস্থা করি।
সিলেট থেকে বাসে করে ঢাকায় ফিরেছি। এটাই ছিল সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা। কারণ, মহাসড়কের বাসে সব সময় হর্নের শব্দ, হাইড্রোলিক ব্রেক, রাস্তার ঝাঁকুনি ইত্যাদি কারণে বিড়ালটি খুবই অস্বস্তিতে ছিল। জোরে জোরে ডাকছিল। একসময় ব্যাগেই প্রস্রাব করে দেয়। সব মিলিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে।
পরে টুকিকে নিয়ে আরও দুটো ট্রেনযাত্রা করেছি। কোলে বসে বেশ আরামেই ভ্রমণ করেছে। এ ক্ষেত্রে লিটার বক্স কাছে রাখার বিষয়টা বেশ কাজে দিয়েছিল।
সামনের অংশে স্বচ্ছ প্লাস্টিক, এ ধরনের দুই কাঁধে ঝোলানো ব্যাগগুলো দেখতে ফ্যাশনেবল হলেও ভেতরে বেশ গরম। অন্তত আমাদের বিড়াল খুব একটা উপভোগ করেনি। এর চেয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়িতেই তুলনামূলক আরামে থেকেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পোষ্য বিড়ালের সংখ্যা কিন্তু বেশ বেড়েছে। আশপাশের বন্ধুবান্ধব, পরিচিত-অপরিচিতদের দেখে অন্তত তেমনটাই মনে হয়। এই যেমন আমাদের বাসায় বিড়াল আসার পরই কমপক্ষে তিনজন পরিচিত মানুষ বিড়ালপোষ্য নিয়েছেন। যদিও দেশে এ নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না, আমার জানা নেই। এই অভিজ্ঞতা লিখতে যেয়েই জানলাম, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের (আইএফএডব্লিউ) তথ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় ৬০ কোটি বিড়ালের মধ্যে ৪০ কোটিরই বাস এশিয়ায়। এর মধ্যে শুধু চীনেই আছে ৫ দশমিক ৮ কোটি গৃহপালিত বিড়াল। বাংলাদেশেও এ রকম পরিসংখ্যান থাকা দরকার।
প্রাণিচিকিৎসক ডা. হাসানুল হক ইমন এ ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। রাজধানীর মাটিকাটা এলাকার সিটি পেট কেয়ারের এই ভেটেরিনারি পরামর্শক বলেন, বিড়ালকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার আগে সঠিক প্রস্তুতি থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
১. সঠিক প্রস্তুতি যাত্রাকে সহজ করে
দীর্ঘ ভ্রমণের আগে বিড়ালের একটি সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা খুবই জরুরি। অসুস্থ হলে পোষ্যকে নিয়ে ভ্রমণ করা যাবে না। তাই প্রাণিচিকিৎসকের (ভেটেরিনারি চিকিৎসক) পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী প্রস্তুতি নিতে হবে। শুরুতেই আপনার বিড়ালের জন্য একটি ভালো মানের ‘ক্যারিয়ার’(ব্যাগ, ঝুড়ি ইত্যাদি) নিন। এটির আকার এবং ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা যথেষ্ট কি না, নিশ্চিত হোন। এমন ক্যারিয়ার নির্বাচন করতে হবে, যেন বিড়াল দাঁড়াতে, ঘুরতে এবং শুতে পারে। ক্যারিয়ারের লক সিস্টেম শক্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আদরের প্রাণীটিকে নিয়ে ভ্রমণের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহনে যাতায়াত করা ভালো।
এ ছাড়া পূর্বেই জেনে নিন, আপনার যাত্রার নির্ধারিত পরিবহন এবং হোটেল বা রিসোর্টে বিড়াল রাখার অনুমতি আছে কি না।
২. নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত করা
ঘুরতে যাওয়ার কিছুদিন আগ থেকেই বিড়ালকে দিনে ২ থেকে ৩ বার ক্যারিয়ারে রেখে অভ্যস্ত করতে হবে। তাকে নিয়ে আশপাশে ঘুরে আসতে পারেন। এতে প্রাণীটি ভিন্ন পরিবেশে মানসিক চাপ সামলানো শিখবে। ব্যাগের নিচে নরম কাঁথা বা তোয়ালে দেওয়া যেতে পারে। রাখতে পারেন আপনার ব্যবহৃত কম্বল বা আপনার গায়ের গন্ধযুক্ত কাপড়। এতে সে আপনার উপস্থিতি অনুভব করবে। ভেতরে খাবার এবং পানির বাটি রেখে খাওয়া শেখাতে পারেন।
৩. খাবারদাবার
ভ্রমণের কমপক্ষে তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে আপনার পোষা প্রাণীটিকে খাইয়ে নিতে হবে। খাওয়ার পরপরই ভ্রমণ করলে বিড়ালের বমি হতে পারে। সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে (তিন থেকে চার ঘণ্টা) খাবার না দিয়ে শুধু পানি দিলেও চলে। দীর্ঘ ভ্রমণে (৬ ঘণ্টার বেশি) প্রতি ৬-৭ ঘণ্টা পরপর হালকা খাবার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুকনা খাবারই বেশি ভালো কারণ এটি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম। পান করতে দেবেন বিশুদ্ধ পানি। তবে খেতে না চাইলে জোর করে কিছু খাওয়ানো যাবে না। বিড়াল বেশি ভয় পেলে বা আক্রমণাত্মক আচরণের আশঙ্কা থাকলে ভেটের পরামর্শে কিছু ওষুধ সঙ্গে রাখতে পারেন।
৪. আঁচড়ে–কামড়ে দিলে
আদরের পোষা বিড়ালটিও ভয় পেয়ে আপনাকে বা পাশের কাউকে কামড় বা আঁচড় দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ক্ষতস্থানটি ক্ষারজাতীয় সাবান এবং কুসুম গরম পানি দিয়ে পাঁচ মিনিট ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। এরপরে পরিষ্কার করতে হবে ক্লোরোহেক্সিডিন বা ভায়োডিন দিয়ে। রক্তপাত বন্ধ না হলে গজ বা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে চেপে ধরুন। পরে প্রতিদিন জায়গাটিতে অ্যান্টিবায়োটিক অয়েন্টমেন্ট লাগানো যেতে পারে। গভীর কামড়, ফুলে যাওয়া বা পুঁজ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
শতভাগ বাসায় আবদ্ধ বিড়ালকে রেবিস ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আপনার বিড়ালটির এই ভ্যাকসিন দেওয়া না থাকলে বা বাইরের কোনো বিড়াল কামড় বা আঁচড় দিলে অবশ্যই আক্রান্ত ব্যক্তির ভ্যাকসিন নেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
৫. পোষা প্রাণীর টিকা
বাংলাদেশে বিড়ালকে মূলত দুটি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। সাধারণত প্রথম ছয় থেকে আট সপ্তাহ বয়সে দেওয়া হয় প্রথম কোরভ্যাকসিন (এফভিআরসিপি)। অনেকে এটিকে ফ্লু টিকা নামে চেনে। বিড়াল ছানার বয়স যখন ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহ, তখন দেওয়া হয় রেবিস ভ্যাকসিন এবং এফভিআরসিপির দ্বিতীয় ডোজ। এরপর বছরে একবার করে এই ভ্যাকসিনগুলোর বুস্টার ডোজ নিতে হয়।