মানুষ যখন মা–বাবা হয়ে যান, তখন তাঁদের বেশির ভাগ চিন্তাজুড়ে থাকে সন্তানের ভালো-মন্দ, লেখাপড়া, তার সুন্দর বেড়ে ওঠা। আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক, সেরা স্কুল, সেরা শিক্ষা, সেরা পরিবেশ—সন্তানের জন্য সব সেরাটা দিতে চান অধিকাংশ মা-বাবা।
ফলে অনেক সময় মনে হয়, এসব কিছু মা–বাবার সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে তো! তবু তাঁরা ভ্রুক্ষেপ করেন না। শুধু কী লেখাপড়া? নাচ, গান, ছবি আঁকা, ক্রিকেট-ফুটবল কোচিং—এসব কিছুতেও ব্যয় করতে হবে। কোনো কিছুতেই পিছিয়ে থাকা চলবে না।
এ বিষয়ে প্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের ডিপার্টমেন্ট অব কন্টিনিউইং এডুকেশন অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের বিভাগীয় প্রধান তানিয়া রুবাইয়ার সঙ্গে কথা বলি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই প্রশ্নের আক্ষরিক উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, এখানে শিশুর শিক্ষার জন্য সব ধরনের সুবিধা একসঙ্গে পাওয়া যায় না। মা-বাবার নানা সুবিধা-অসুবিধার ওপর মূলত এটা নির্ভর করে।
নিজের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে যে স্কুলে পড়াই সেটা হয়তো আমাদের জন্য কিছুটা বাড়তি খরচ। কিন্তু আমার অফিস এলাকা, বাসায় আসা–যাওয়ার সুবিধা, ওকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার সুবিধা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে আমরা ওকে এখানে পড়াই। স্কুল নির্বাচন করতে কিন্তু কেবল পড়ালেখার মান বা খরচ বিবেচনায় নিইনি আমরা। যেহেতু আমি কর্মজীবী মা, আমি দেখেছি যে কোথায় ওকে ভর্তি করলে আমার কাজ চালিয়ে যাওয়া সহজ হবে, কোথায় ভর্তি করাটা চলাফেরার জন্য নিরাপদ।’
নিজে সরকারি স্কুলে পড়েছেন কিন্তু ছেলের জন্য বাধ্য হয়েই বেসরকারি স্কুল বেছে নিতে হয়েছে জানিয়ে তানিয়া বলেন, ‘কারণ, আমাদের সময় তো স্কুলে যাওয়া–আসা নিয়ে মা-বাবাকে চিন্তা করতে হতো না। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের স্কুলে ভর্তি হলেও কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু এখন যদি ওকে আমি আমার পছন্দের স্কুলে পড়াতে যাই, তাহলে দেখা যাবে, সেখানে আনা-নেওয়ার জন্য আমাকেই চাকরি ছাড়তে হবে। তার চেয়ে কিছুটা বেশি খরচ দিয়ে হলেও সুবিধাজনক স্কুলে পড়াই। যেন আমার চাকরি করাটা নির্বিঘ্ন হয়, যেন স্কুলে যাওয়ার পথ নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে না হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সাবেক শিক্ষার্থী বললেন, এভাবেই আমাদের দেশের মা-বাবারা সবদিক বিবেচনা করে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করেন। তার লেখাপড়া চালিয়ে যান। তাঁরা সন্তানের শিক্ষা খাতে তাঁদের আয়ের কতটুকু ব্যয় করবেন, তা কোনো ধরাবাঁধা নিয়মে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ, প্রত্যেকের পরিস্থিতি আলাদা। কেউ গুরুত্ব দেন লেখাপড়ার মান, কেউ স্কুলের সুনাম, কেউ পথের দূরত্ব আবার কেউ গুরুত্ব দেন দৈনন্দিন জীবনের সার্বিক সুবিধাকে। সেই অনুযায়ীই তারা তাঁদের জীবন সাজিয়ে নেন।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষালোকের নির্বাহী সম্পাদক আলমগীর খান বললেন, ‘সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় তো অভিভাবকের কোনো ব্যয়ই থাকার কথা নয়। বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে। পরের ধাপগুলোয় যে ব্যয় হওয়ার কথা, সেটাও সহনীয় থাকার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে তো সেটা হচ্ছে না। কারণ, এখানে প্রাইভেট না পড়ালে, গৃহশিক্ষক না রাখলে, কোচিং না করালে শিশুর ভালো ফলাফল সম্ভব নয়। এটা আসলে রাষ্ট্রীয়ভাবে হওয়া অন্যায়।’
আলমগীর খান বলেন, এখন অভিভাবকেরা যে অতিরিক্ত ব্যয় সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে করছেন, সেটার জন্য রাষ্ট্র আসলে তাদের বাধ্য করছে। ভালো স্কুলে না পড়লে, কোচিং না করলে ভালো রেজাল্ট হচ্ছে না। আর ভালো রেজাল্ট না হলে ভালো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছে না। কিন্তু শিক্ষার তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। শিক্ষা তো রাষ্ট্রের নাগরিকের মৌলিক অধিকার!
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় লেখাপড়ার মান কমে যাওয়ায় অনেক অভিভাবক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছেন উল্লেখ করে আলমগীর খান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ভালোভাবে কাজ করত, তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে যাওয়ারই প্রয়োজন পড়ত না। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দিতে অর্থের বিনিময়ে হলেও আরও ভালো শিক্ষা বা সেবা দিতে চেষ্টা করত। কিন্তু যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরই মান ঠিক নেই, তাই বেসরকারিগুলোও নিজেদের মান উন্নত করার তেমন চেষ্টা করে না। ফলে অর্থও ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে মানসম্মত শিক্ষাও পাওয়া যাচ্ছে না।
তাই অভিভাবকের এই বাড়তি ব্যয়ের দায় রাষ্ট্রকেই দিলেন আলমগীর খান।
সন্তানের পড়ালেখার পেছনে কেমন ব্যয় করেন জানতে দুজন অভিভাবকের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। তাঁদের একজনের সন্তান ইংরেজি মাধ্যমে, অন্যজনের সরকারি স্কুলে পড়ে।
ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিশুর অভিভাবক তানজিকা হোসেন বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে, ভবিষ্যৎ গড়তে হলে আসলে লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় করতেই হবে। হ্যাঁ, আমাদের মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী পরিবারের জন্য মাঝেমধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোটা বেশ কষ্টের হয়ে যায়। প্রতিযোগিতায় সন্তানকে টিকিয়ে রাখতে গান, ছবি আঁকাও শেখাতে হয়। নিয়মিত কোচিং করাতে হয়। ফলে সব মিলিয়ে বেশ খরচ।’ কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও তো নেই, যোগ করেন তিনি।
বাংলা মাধ্যম পড়ুয়া শিশুর বাবা মহসিন বিন আলমেরও প্রায় একই সুর। তিনি বলেন, স্কুলে যা পড়ায়, তাতে তো হয় না। কোচিং করাতে হয়, বাসায় টিউটর রাখতে হয়। নাহলে পরীক্ষায় ভালো করতে পারে না। সরকারি স্কুলে বেতন কম, কিন্তু ক্লাসে এক থেকে দশের মধ্যে রোল রাখতে গেলে আপনাকে অবশ্যই কোচিংয়ে দিতে হবে, টিউটরও রাখতে হবে। ‘আর শুধু লেখাপড়া শেখালেই তো হবে না। আমরা চাই আমাদের মেয়ে যেন নাচ, কবিতা, গান এসব কিছুতেও পারদর্শী হয়। তো এগুলোর জন্যও ব্যয় করতে হয়। এগুলো তো আর স্কুলে শেখাবে না, তাই না?’
তবে সহজপাঠ উচ্চবিদ্যালয়ের ট্রাস্টি ও শিক্ষক সিদ্দিক বেলাল মনে করেন, শিশুর বয়স ১৫ বছর হওয়া পর্যন্ত ওর পেছনে বাড়তি কোনো খরচই করা উচিত নয়। এই সময় কেবল স্কুলে যেটুকু পড়ায়, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট। বাড়তি কোচিং, টিউটর কিছুই এ সময় প্রয়োজন হয় না।
সিদ্দিক বেলাল বলেন, এমনকি নাচ, গান, ছবি আঁকা, সাঁতার, ক্রিকেট যা–ই বলেন না কেন, এই বয়সের পর শেখাতে হয়। অনেকেই বলেন, ছোটবেলা থেকে শেখালে তার আগ্রহের জায়গাটা বোঝা যাবে। এটা ভুল ধারণা। মোটামুটি ১৫ বছরের মধ্যেই শিশুর আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়ে যায়। তখন সেই অনুযায়ী বাড়তি কিছু শেখানো যেতে পারে।
দীর্ঘদিন শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করে আসা এই শিক্ষক বলেন, ‘আমরা বলি, শিশুর জীবনের প্রথম ১০ বছর ওকে কিছুই শেখাবেন না। ও নিজেই যখন আগ্রহ দেখাবে, কোনো বিষয়ের প্রতি ওর ঝোঁক তৈরি হবে, তখন বুঝেশুনে সেটা শেখাবেন।’
আমাদের দেশের অনেক অভিভাবক কেবল ভালো রেজাল্টের পেছনে ছোটেন। সে প্রসঙ্গ টেনে সিদ্দিক বেলাল বলেন, অভিভাবকদের মানসিকতায় এই পরিবর্তনটা ১৯৮৫ সালের পর এসেছে। নামকরা স্কুলের পেছনে ছোটা, ভালো রেজাল্টের জন্য অতিরিক্ত চাপ দেওয়া—এসব সে সময় থেকেই শুরু হয়েছে।
তবে ভালো রেজাল্টের জন্য এই দৌড়ে চলার অর্থ পান না সিদ্দিক বেলাল। তাঁর মতে, শিশুকে আনন্দ নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। পড়ায় বা শেখায় আনন্দ না পেলে দামি স্কুল, কোচিং, টিউটর; কোনো কিছুই আসলে কাজে আসবে না।