তিন গোয়েন্দা সিরিজের জনপ্রিয় কয়েকটি বই
তিন গোয়েন্দা সিরিজের জনপ্রিয় কয়েকটি বই

ভাঙারির দোকানি জানতেন না, কী অমূল্য জিনিস তুলে দিলেন আমার হাতে

আমরা যখন স্কুলে পড়েছি, তখনো ইন্টারনেট আজকের মতো এতটা বিস্তৃত পরিসরে পৌঁছায়নি। অন্তত মফস্‌সল শহরে বড় হওয়ায় আমার অভিজ্ঞতায় স্কুলজীবনে মুঠোফোন বলতে দেখেছি কেবল ‘বাটন ফোন’। বোধ করি, এ কারণেই বিভিন্ন খেলাধুলার পাশাপাশি অবসরের সময়টা দখল করেছিল গল্প, উপন্যাস। ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই সহজলভ্যতায় বড় হলে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠত কি না, কে জানে।

‘তিন গোয়েন্দা’র স্রষ্টা রকিব হাসান প্রয়াত হয়েছেন ১৫ অক্টোবর। কখনো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, কথা হয়নি। তারপরও তাঁর মৃত্যুর খবরটা শুনতেই বেদনায় মনটা ছেয়ে গিয়েছিল। চোখে ভাসছিল কিশোর পাশার সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি। কবি, লেখক, সৃষ্টিশীল মানুষের প্রাপ্তি বোধ হয় এখানেই। শব্দে, অক্ষরে, চিত্রকল্পে চরিত্রের মধ্য দিয়েই তাঁরা স্থান করে নেন পাঠকের হৃদয়ে।

কিশোর পাশাকে প্রথম পেয়েছিলাম পুরোনো মালামাল দিয়ে নতুন মালামাল নেওয়ার ভ্রাম্যমাণ দোকানে। তখন গ্রামে থাকি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সামনে বৃত্তি পরীক্ষা। দারুণ চাপ পড়ার। সব সময় মা-বাবা, পরিবারের সবাই ‘পড়তে’ বলেন। সকাল-বিকেল স্যার আসেন পড়াতে।

মডেল টেস্ট দিতে কোচিংয়েও যেতে হয়। আর সারাক্ষণ ‘বৃত্তি পাওয়ার বই’ পড়তে এত কার ভালো লাগে! অন্তত আমার মতো ‘পড়াচোর’দের তো ভালো লাগে না। তাই সুযোগ পেলেই ক্লাসের বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ি।

এর মধ্যে একদিন পুরোনো মালামালের; বরং বলা ভালো ভ্রাম্যমাণ ভাঙারির দোকানি আসার শব্দ পেয়ে গেলাম দৌড়ে। ভাঙারির দোকানিরা বোতল ছিদ্র করে বোতলের সঙ্গে একটা মার্বেল বেঁধে বাজাতে বাজাতে আসতেন। খটখট ধরনের একটা শব্দ হতো।

বলা দরকার, পুরোনো মালামালের দোকান হলেও পুরোনো বই-খাতা-কাগজও কিনতেন তাঁরা। যদিও বলেছি দৌড়ে গেলাম, কিন্তু এই দৌড়ে যাওয়ার কারণ ‘কিশোর পাশা’ ছিল না। কারণ ছিল ‘বুটভাজা’। খেতে বেশ মজা।

দুই টাকায় অনেকগুলো পাওয়া যেত। সেদিন বুটভাজা কেনার উদ্দেশ্যে গেলেও হঠাৎ পুরোনো বই-খাতা রাখা চাঙাড়ির ওপর চোখ চলে যায়। পুরোনো, ময়লা লাগা একটা বই। বইয়ের পেছনে লেখা, ‘হ্যাল্লো কিশোর বন্ধুরা—আমি কিশোর পাশা বলছি আমেরিকার রকি বিচ থেকে...’

তখনো গোয়েন্দা কাহিনির সঙ্গে পরিচয় হয়নি। তাই কিছুটা উৎসাহের সঙ্গেই পকেটে থাকা বুটভাজা কেনার দুই টাকা বের করে দোকানি কাকুকে বলি, ‘কাকু, এই বইটা নিই।’
‘টাকা লাগবে না, নিয়ে নে,’ এমন কিছুই সম্ভবত বলেছিলেন দোকানি কাকু। তাঁর কাছে পুরোনো বইটার হয়তো অর্থনৈতিক মূল্য ছাড়া আর কোনো মূল্য ছিল না।

কিংবা কাকু এ–ও জানতেন না, সেদিন তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন। পুরোদস্তুর পাঠক হয়ে ওঠার রসদ। বাড়ি ফিরে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে এক রাতে বইটা পড়েছিলাম। পরদিন কোচিংয়ে মডেল টেস্টে নম্বরও কম পেয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে বকাও খেয়েছিলাম অনেক। তারপর একে একে রকিব হাসানের সঙ্গে পরিচয়। ‘তিন গোয়েন্দা’র পাঠক হয়ে ওঠা।

রকিব হাসান (১২ ডিসেম্বর ১৯৫০-১৫ অক্টোবর ২০২৫)

আমার সূত্রে বন্ধু লিমন আর ইমনও (যমজ দুই ভাই) ‘তিন গোয়েন্দা’র ভক্ত হয়ে গেল। আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হরিহর নদ। আমরা তিনজন নদের পাড়ে বসে প্রায় বিকেলে গল্প পড়ে আলোচনা করতাম।

ইমন একদিন বলল, আমরাও একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলি চল। কিন্তু কে কোন চরিত্র হবে, তা নিয়ে বাধল বিপত্তি। কিশোর পাশা, মুসা আর রবিন। আমি কখনো কাউকে না বললেও মনে মনে দুঁদে গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তখন।

কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বললাম না, কোনো চরিত্রও বেছে নিলাম না। কিশোর পাশাকে নিয়ে ইমন আর লিমনের মধ্যে দেনদরবার চলল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা মিটল না।

আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা খোলার পরিকল্পনাটাও মাঠে মারা গেল। তবে এ কথা সত্য যে ছেলেবেলার আনন্দের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে ছিল কিশোর পাশা, মুসা আর রবিন। আর সহজ–সুন্দর গল্পের বর্ণনা নিয়ে ছিলেন রকিব হাসান। এই ভদ্রলোক ‘তিন গোয়েন্দা’ না সৃষ্টি করলে হয়তো ছেলেবেলার আনন্দে কিছুটা কমতি থেকে যেত।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আছে, ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়/...নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।’ পৃথিবীর অবধারিত ও অবিচল সত্য এটাই। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয়, চলে যেতে হবে।

কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে চিরভাস্বর হয়ে থাকেন। রকিব হাসানও তাঁর কিশোর পাশা, মুসা আর রবিনের মধ্যে আলোকিত থাকবেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা, ছেলেবেলার আনন্দ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।