অভিনয়শিল্পী তানজিম সাইয়ারা তটিনী
অভিনয়শিল্পী তানজিম সাইয়ারা তটিনী

তখনই মনে হয়েছিল, তটিনীর মধ্যে অন্য রকম কিছু আছে

প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩২ সনেও দেশের ক্রীড়া, অভিনয়, গবেষণা, স্থাপত্যসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণকে নিয়ে দুই পাতার আয়োজন থেকে পড়ুন অভিনয়শিল্পী তানজিম সাইয়ারা তটিনীর গল্প।

কয়েক বছর আগে চরকির অ্যান্থলজি সিরিজ এই মুহূর্তের অংশ হিসেবে ‘কল্পনা’ নামে একটি ছোট ফিকশন বানাচ্ছিলাম। সেটার কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন তরুণ অভিনেত্রীর প্রয়োজন ছিল। অনেকের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপও হয়েছিল, কিন্তু কোনোভাবেই মনস্থির করতে পারছিলাম না। অবশেষে অনেকটাই নাটকীয়ভাবে তানজিম সাইয়ারা তটিনীকে চূড়ান্ত করি, সেটাও শুটিং শুরুর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে। অবশ্য তটিনীর সঙ্গে পরিচয় তারও আগে। রাজশাহীতে একটি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে তাঁকে প্রথম দেখি। তখনই মনে হয়েছিল, তাঁর মধ্যে অন্য রকম কিছু আছে—শুধু অভিনয় নয়, বরং একধরনের উপস্থিতি, আত্মস্থতা। পরে জয়া আর শারমিন সিনেমার ছোট্ট একটি দৃশ্যে তাঁকে অভিনয় করার প্রস্তাব দিই।

নিয়মিত বিজ্ঞাপন বানানোর ফলে ভালো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করার খুব একটা সুযোগ হয়ে ওঠে না। একজন নির্মাতা হিসেবে এই ব্যাপারটা আমাকে পোড়ায়ও বটে। কিন্তু ছোট ফরম্যাট হলেও আমার কাছে পারফরম্যান্স সব সময় গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু আমার বেশির ভাগ কাজই গল্পকেন্দ্রিক। সে কারণেই ‘ইনস্টিঙ্কটিভ’ বা সহজাত কোনো প্রতিভা আমার চোখ এড়ায় না। প্রথম দু-তিনটি কাজেই তটিনীর স্পার্কটা অনুভব করি। মাত্র কয়েক বছর পর এখন তিনি দেশের পরিচিত মুখ, কাজের ভান্ডারও সমৃদ্ধ। নাটক, বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন অবিরাম।

তটিনী নাটক, বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন অবিরাম

আমার মনে হয়, অভিনয়ের প্রতি তটিনীর দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ। একদিকে সহজাত অভিনয়প্রতিভা, অন্যদিকে পদ্ধতিগত প্রস্তুতি—এই দুটোর ভারসাম্য খুব অল্প সময়েই তিনি রপ্ত করতে পেরেছেন। মুহূর্তেই চরিত্রের মনোজগৎ বুঝতে পারার ক্ষমতা, চোখের ভাষায় কথা বলা এবং শরীরী ভাষায় চরিত্রকে প্রকাশ—এগুলো সাধারণত সময় নিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু শুরু থেকেই তটিনীর কাজে এ সবকিছুর প্রতিফলন ছিল।

‘কল্পনা’ বানানোর সময় অনেক চাপ ছিল। একদিকে সময় কম, তা ছাড়া প্রস্তুতি নেওয়ারও তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু তটিনী ব্যতিক্রম। এত ঝামেলার মধ্যেও তিনি প্রতিটি দৃশ্যের জন্য নিজের মতো করে প্রস্তুত হয়েছিলেন। শুটিংয়ের কোলাহলে ক্যামেরা রোল হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে যেন নিজের ভেতরে এক মানসচিত্র এঁকে নিতেন। সারা যাকের, জাহিদ হাসানের মতো দিকপালদের সঙ্গে পর্দা ভাগাভাগি করেও তিনি নিজের জায়গা ঠিকঠাক ধরে রাখতে পেরেছিলেন, জানান দিতে পেরেছিলেন নিজের সপ্রতিভ উপস্থিতি। আর তখনই আমার মনে হয়েছিল, আমরা পেয়েছি আরেকজন সহজাত অভিনেত্রী।

তানজিম সাইয়ারা তটিনী

নির্মাতা হিসেবে দেশের অনেক গুণী অভিনেতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। শুটিংয়ের সময় আমি ক্যামেরার খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকি, দেখতে থাকি কীভাবে অন্য এক দুনিয়ায় ঢুকে পড়েন অভিনেতা। নির্মাতার নির্দেশ বুঝে নিয়ে পারফর্ম করা, পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এবং সেই সঙ্গে নিজের আবেগটুকু ধরে রাখার ক্ষমতা—এই ভারসাম্য বজায় রাখার দক্ষতা খুব সহজে আসে না। অনেক বছর আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে জুডিথ ওয়েস্টনের একটি কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলাম। তাঁর লেখা বই ছিল আমার অভিনয় নির্দেশনার মূল ভিত্তি। তটিনীর সঙ্গে কাজ করার পর মনে হয়েছিল, বইটা তাঁকে উপহার দেওয়া উচিত। পরে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি, ‘বইটা পড়া শুরু করেছ?’ তিনি মৃদু হেসে বলেছেন, ‘না, এখনো না।’

এ বছরের শুরুতে আমরা আবার একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করলাম। ‘কল্পনা’র ঠিক তিন বছর পর। ক্যামেরা অন হওয়ার ঠিক আগে সিনেমাটোগ্রাফারের দিকে তাকালাম। সেও মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, মেয়েটা কতটা এগিয়ে গেছে! দৃশ্য শুরু করার আগে তটিনী হেসে অনুরোধ করলেন, আমি যেন তাঁর আইলাইনের সামনে না থাকি, যেন একটু দূরে থাকি।

ছোট্ট অনুরোধ, কিন্তু স্পষ্ট বার্তা। এখন তিনি জানেন, তিনি কী করছেন।

তখনই বুঝেছিলাম, আমার দেওয়া বইটি সঠিক হাতেই গেছে।

পিপলু আর খান: নির্মাতা