১০ বছরেও খোঁজ মেলেনি মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটির, এখনো অপেক্ষায় স্বজনেরা

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ছেড়ে যাওয়ার ৪০ মিনিট পর গায়েব হয়ে যায় আস্ত উড়োজাহাজ
ছবি: পেক্সেলস

ভারতে ২৪২ যাত্রী নিয়ে উড়তে না উড়তেই এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট বিধ্বস্ত হওয়ার খবর এখনো দগদগে ক্ষত হয়ে আছে সবার মনে। ফ্লাইটটির আরোহীদের মধ্যে বেঁচে ফিরেছেন কেবল একজন, বাকিরা ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন।

দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমগুলোয় যখন উঠে আসছে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর আহাজারি, তখন নতুন করে ক্ষত জেগে উঠছে পৃথিবীর কিছু মানুষের। যাঁরা আজ থেকে ১১ বছর আগে এক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় হারিয়েছিলেন স্বজন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই স্বজনদের মৃত্যুর কারণ তাঁদের অজানা। নিশ্চিত হওয়া যায়নি তাঁদের স্বজনেরা আদতেই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, নাকি স্রেফ ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। বলছি মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৩৭০–এর কথা। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ যেটি ২২৭ জন যাত্রী আর ১২ জন ক্রু নিয়ে উড়াল দিয়েছিল মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে। গন্তব্য ছিল চীনের বেইজিং।

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ছেড়ে যাওয়ার ৪০ মিনিট পর ক্যাপ্টেন জাহারি আহমেদ শাহ বাহনটি নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন ভিয়েতনামের আকাশসীমায়। মালয়েশিয়ার আকাশসীমা ছেড়ে যাওয়ার সময় ট্রাফিক কন্ট্রোলের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘গুড নাইট মালয়েশিয়ান থ্রি সেভেন জিরো।’

এর ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই রাডার থেকে গায়েব হয়ে যায় আস্ত উড়োজাহাজটি। ক্যাপ্টেন বা বাহনের কোনো ক্রুয়ের কাছ থেকেও আসেনি আর কোনো বার্তা। বন্ধ হয়ে যায় ফ্লাইটের ট্রান্সপন্ডার এবং কোনোভাবে এর ট্র্যাকিং সিস্টেমও বন্ধ হয়ে যায়।

বাণিজ্যিক রাডারে এরপর বাহনটির আর কোনো তথ্য নেই। তবে সামরিক রাডারের তথ্য বলছে, এরপর উড়োজাহাজটি দিক পরিবর্তন করে বাঁয়ে অগ্রসর হয় এবং উত্তর মালয়েশিয়া ও পেনাং দ্বীপের দিকে এগোয়। এরপর আন্দামান সাগর হয়ে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের শেষ প্রান্তের দিকে চলে যায়। ওই রাডারে থাকা সবশেষ তথ্য হলো, ৮ মার্চ মালয়েশিয়া সময় রাত ২টা ২২ মিনিটে উড়োজাহাজটি দক্ষিণে বিস্তৃত ভারত মহাসাগরের দিকে উড়ে যায়।

এত বিশাল একটি উড়োজাহাজ, এতজন আরোহী নিয়ে এভাবে মিলিয়ে যেতে পারে কি না, তা নিয়ে ওঠে নানা প্রশ্ন। ভারত মহাসাগরের ১ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তল্লাশি চালিয়েও পাওয়া যায়নি এর কোনো খোঁজ। মালয়েশিয়ার সঙ্গে অনুসন্ধানে নামে বিশ্বের ২৪টিরও বেশি দেশ। তবে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এমএইচ ৩৭০–কে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় জানিয়ে তল্লাশি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও এর আগে ২০১৫ সালের আগস্টে এক সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের রিইউনিয়ন দ্বীপে নিখোঁজ উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষের একটি টুকরা পাওয়া গেছে।

যদিও এই দাবি মেনে নেননি নিখোঁজ বাহনটির যাত্রীদের স্বজনেরা। তাঁরা সব সময়ই নতুন করে অনুসন্ধানের দাবি জানিয়ে আসছেন।

নিখোঁজের পর থেকে উড়োজাহাজটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব হাজির করা হতে থাকে। কেউ বলেন, ফ্লাইটটি ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিল; কেউ বলছিলেন, পাইলট হয়তো মানসিক অবসাদ থেকে গোটা বিমান নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন; কেউ বলেন, হয়তো ভূমি থেকে গুলি করে এটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো দাবির পক্ষেই এমন কোনো তথ্য–প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যাতে সেটি মেনে নেওয়া যায়। এমনকি এটি ভিনগ্রহের প্রাণীর কারসাজি, এমন তত্ত্বও দিয়েছিলেন কেউ কেউ!

বোয়িং ৭৭৭ মডেলের ২১০ ফুট লম্বা, ডানাসহ ২০০ ফুট প্রশস্ত এবং ৬২ ফুট উচ্চতার লেজবিশিষ্ট একটি উড়োজাহাজ কীভাবে মাঝ–আকাশ থেকে কোনো চিহ্ন না রেখে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, তা এখনো বুঝে উঠতে পারেন না অনেকে।

পাইলট কেন দিক পরিবর্তন করেছিলেন, শেষ মুহূর্তে কেন পাইলন মে-ডে কল দেননি কিংবা এর ব্ল্যাকবক্সই–বা কেন পাওয়া যায়নি; এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি। তাই ওই সব ধ্বংসাবশেষ যে আদতেই নিখোঁজ উড়োজাহাজটির, তা–ও মেনে নেননি স্বজনেরা। তাঁরা স্পষ্ট প্রমাণ চান। কী হয়েছিল তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে, তার সঠিক তথ্য চান।

দুর্ঘটনার পর শুরুতেই সন্দেহের তীর যায় পাইলট জাহারি আহমেদ শাহের দিকে। সহকর্মীদের কাছে সুখী ও স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত এই পাইলটের বাড়িতে অভিযান চালায় মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ এবং এফবিআই। সে সময় দাবি করা হয়েছিল, পাইলটের বাড়ি থেকে একটি ফ্লাইট সিমুলেটর উদ্ধার করা হয়েছিল, যার সঙ্গে এমএইচ ৩৭০–এর যাত্রাপথের মিল আছে।

তখন একটি ধারণার জন্ম নেয়—হয়তো পাইলট আগে থেকেই উড়োজাহাজটি ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এটি প্রমাণেও খুব শক্তিশালী যুক্তি কেউ দেখাতে পারেনি।

২০১৯ সালে নিখোঁজ উড়োজাহাজ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিমান চলাচলবিষয়ক সাংবাদিক জেফ ওয়াইজ। তাঁর দাবি, উড়োজাহাজটি ভিয়েতনামের আকাশসীমায় প্রবেশ করতেই এর দখল নেয় ভেতরে থাকা এক বা একাধিক ছিনতাইকারী। এমনকি ওই বইয়ে ককপিটে না গিয়েও কীভাবে ফ্লাইটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায়, তাঁরও ব্যাখ্যা দেন তিনি।

যেহেতু ভারত মহাসাগরের ওপর এমএইচ৩৭০–এর সবশেষ অবস্থান জানা গিয়েছিল, তাই অনেকই ধারণা করেন, সেখানেই এটি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘ এই মহাসাগরের কিছু অংশের গভীরতা চার হাজার মিটারের বেশি। ফলে সেখানে ডুবে গিয়ে থাকলে তা পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়।

ইউনিভার্সিটি আব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার কোস্টাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক চারিথা প্যাট্টিয়ার্চিসহ গবেষকদের একটি দল উড়োজাহাজটির সন্ধান পেতে পানির প্রবাহ বিশ্লেষণ করেছিলেন। আল–জাজিরাকে তিনি বলেছিলেন, উড়োজাহাজটির ধ্বংসাবশেষ পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোর উপকূলের দিকে প্রবাহিত হওয়ার কথা।

চারিথা প্যাট্টিয়ার্চি বলেন, ‘গত ১০ বছরে প্রযুক্তির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একই সঙ্গে সমুদ্রের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন উড়োজাহাজটির খোঁজ পাওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।’

যদি সত্যিই এমএইচ ৩৭০ সমুদ্রে ডুবে গিয়ে থাকে, তাহলে এত বছর পর এর ব্ল্যাকবক্স খুঁজে পাওয়া সম্ভব কি না, কিংবা পাওয়া গেলেও সেখান থেকে কোনো তথ্য আর পাওয়া যাবে কি না; তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেলে অন্তত নিখোঁজদের স্বজনেরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন, অন্তত জানবেন যে ঠিক কোথায় সমাধি হয়েছে তাঁদের স্বজনদের, সেটাই বা কম কিসে!

সূত্র: আল–জাজিরা, বিবিসি ও ব্রিটানিকা