জরুরি প্রয়োজনে টাকা ধার করা লাগতেই পারে। কিন্তু টাকা ধার করাটা যদি অভ্যাস হয়ে ওঠে, তাহলেই বিপদ। নিয়মিত ধার মোটেও ভালো অভ্যাস নয়। বরং ঋণী ব্যক্তি আজীবন দরিদ্র থাকেন। ধারের টাকা শোধ করতে না পেরে মানসিক অবসাদে ভোগেন কেউ কেউ। আর্থিক চাপে কেউ কেউ আবার নানা অঘটনও ঘটিয়ে ফেলেন।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) পরিচালিত একটি গবেষণায় দেশের মানুষের ঋণ করার প্রধান কারণগুলো উঠে এসেছে। দেখা গেছে, সংসার খরচ মেটাতেই সবচেয়ে বেশি ঋণ করেন মানুষ। আরও আছে চিকিৎসা খরচ, বাড়ি তৈরি, বাকি খাওয়া ও ব্যবসার জন্য ঋণ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে যে অর্থনৈতিক অসমতা বিরাজমান, মানুষের মধ্যে তা একধরনের চাপ তৈরি করে। অসমতার কারণে একজন ব্যক্তি তাঁর সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের মতো করে নিজের জীবনযাপন করতে চান। দুজনের হয়তো বয়স কাছাকাছি কিন্তু আয়ের দিক থেকে একজন তুলনামূলক অনেক এগিয়ে। যার আয় কম, তিনিও যখন বেশি আয়ের ব্যক্তির মতো জীবনযাপন করতে চান, তখন সেটা তাঁর জন্য একটা চাপ হয়ে ওঠে।
খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের দেশে দুই ধরনের মানুষের হাতেই সর্বোচ্চ দামি স্মার্টফোন আছে। যিনি এটা অ্যাফোর্ড করতে পারেন, তাঁর হাতে যেমন আছে, যাঁর হয়তো এটা কেনার সামর্থ্য নেই, আর এতটা দামি ফোন না হলেও চলে, তিনিও সেটা কিনছেন। সেটা কেনার জন্য হয়তো একজনের ঋণ করতে হয়েছে, কিন্তু তারপরও তিনি সেটা ব্যবহার করছেন। এমন কারণেও ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে ধার করতে হয়।’
গবেষণা বলছে, যখন মানুষ বেশি আয় করে, তখন খাবারের চেয়ে বিলাসী জীবনযাপনে বেশি খরচ করে। তবে ধার করে অন্যের মতো বিলাসী জীবনযাপনের ঝোঁক বরং মানুষকে ঋণগ্রস্ত করে। তাই ধার করার মতো বদভ্যাস বদলানোর জন্য কিছু কার্যকর উপায় জেনে নিন।
মাসের শুরুতে আপনার আয় ও মাসিক খরচের তালিকা তৈরি করুন। কোন জায়গায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হচ্ছে চিহ্নিত করুন। মানুষের যখন নিজের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকে, তখন ধারের দিকে ঝোঁক কমে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনে নানা ধরনের পরিবর্তন আসবে, এটাও সত্যি। তাই পুরোপুরি গরিবি হালে না চলতে চাইলে বরং বিকল্প আয়ের পথ তৈরি করতে পারেন।
এই বাজেট মানে হলো আয় অনুযায়ী ব্যয়ের পরিকল্পনা। প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য আলাদা এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য আলাদা বাজেট তৈরি করুন। সঠিকভাবে বাজেট তৈরি করতে পারলে সেটা মেনেই টাকা ধার করার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা যাবে। বাইরে খেতে যাওয়ার অভ্যাস আধুনিক জীবনযাপনে একধরনের বিনোদন। তবে প্রতি শুক্রবার বাইরে খেতে যাওয়ার কারণে যদি ধার করতে হয়, তাহলে সেটা ভালো অভ্যাস নয়। সে ক্ষেত্রে বাজেটে মাসে চার দিনের বদলে সামর্থ্য বুঝে এক বা দুই দিন বাইরে খেতে পারেন। জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রেই এমন অভ্যাসের চর্চা করতে হবে। আবার কেউ হয়তো বাইরে খাওয়া বলতেই দামি রেস্তোরাঁয় যাওয়া বোঝেন, কেউ ফাস্টফুডের দোকান।
মাসে সামান্য হলেও কিছু টাকা ‘জরুরি ফান্ড’ হিসেবে আলাদা করে রাখুন। পারিবারিক এমন তহবিল থাকলে হঠাৎ খরচের জন্য ধারের ওপর নির্ভর করতে হয় না। এই অভ্যাস অনেকটা মুষ্টির চাল সংগ্রহের মতো। একটু একটু করে জমালে জরুরি দরকারে সেটাই আপনাকে ধারের হাত থেকে বাঁচাবে। তবে জরুরি সময় যেমন ‘জরুরি তহবিল’ থেকে খরচ করবেন, তেমন বিপদ কেটে গেলে আবার সেখানে টাকা রাখার চেষ্টা করতে হবে।
আপনার হাত যদি হয় খরুচে, তাহলে ক্রেডিট কার্ড আপনার জন্য বিপদ বাড়াতে পারে। এ ছাড়া সহজে পাওয়া যায়, এমন ঋণ থেকে দূরে থাকুন। তবে অর্থনীতিবিদ তামিম আহমেদের পরামর্শ হলো, ক্রেডিট কার্ড অনেক সময় উপকারীও। এতে অন্যের কাছে হাত পাতার দরকার পড়ে না। বুঝে খরচ করতে পারলে বাড়তি ফি–ও এড়ানো সম্ভব।
যেমন কেউ যদি জরুরি দরকারে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, ৪৫ দিনের মধ্যে সেই টাকা জমা দিলে কোনো বাড়তি ফি দিতে হয় না। ক্রেডিট কার্ডের জন্য বছরে যে ফি দিতে হয়, সেটাও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন করে ফ্রি করে নেওয়া যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে কৌশলী হওয়া জরুরি।
বড় কেনাকাটা করার আগে কয়েক ঘণ্টার বিরতি নিন। এটাকে বলে এক রাতের নিয়ম, যেখানে আপনি মনে মনে ভাববেন, ‘আজ রাতটা ভাবি, কাল কিনব।’ সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে একটা বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারেন, দিন শেষে বাইরে থেকে বাড়ি ফিরে অবশিষ্ট কয়েন বা খুচরা টাকা আলাদা করে রাখতে পারেন।
কারও হয়তো প্রতি মাসে নিজের বা পরিবারের জন্য নিয়মিত একটা বড় অঙ্কের টাকা চিকিৎসা বাবদ ব্যয় করতে হয়। সে ক্ষেত্রে তামিম আহমেদের পরামর্শ, নিয়মিত এমন খরচের বিকল্প হতে পারে স্বাস্থ্যবিমা। সেটার জন্য হয়তো শুরুতে একটু বেশি খরচ করতে হবে, তবে এমন উদ্যোগ নিয়মিত চিকিৎসার পেছনে ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে। আবার কারও হয়তো কর্মস্থল দূরের কারণে যাতায়াত ব্যয় অনেক। তিনি হয়তো হিসাব করে কর্মস্থলের কাছাকাছি বাসা নিয়ে সময় ও অর্থিক দিকটা সমন্বয় করতে পারেন। অনেক সময় বড় বড় অফিস–আদালত এলাকার কাছে বাড়িভাড়াও বেশি হয়, তবে সেটা আপনার নিয়মিত যাতায়াতের সঙ্গে সমন্বয় করে দেখতে পারেন। যদি সমান সমান হয়, তাহলেও বাসা এগিয়ে আনা ভালো। এতে সময় বাঁচিয়ে প্রোডাক্টিভ কিছু করে আয় বাড়ানো যেতে পারে। সন্তানদের স্কুলও বাসার কাছাকাছি হলে যাতায়াত খরচ বাঁচানো সহজ হয়।
টাকা ধার নেওয়া মানে সমস্যার সমাধান নয়, বরং সমস্যা বাড়ানো। তাই ধারের আগেই সতর্ক হোন। নিজেই নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে পারেন। ধারে টাকা নেওয়ার বদলে বিকল্প উপায় খুঁজুন। যেমন ধার না করে ঘরের অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করেও আর্থিক সংকট মেটাতে পারেন। এমন কিছু হয়তো আপনার কাছে আছে, যেটা ঘরের এক কোণে পড়ে আছে বছরের পর বছর, সেটা বিক্রি বা বিনিময় করে দরকার মেটানো সম্ভব। শপাহোলিক ব্যক্তিরাও মানসিক নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে এড়াতে পারেন বাড়তি খরচ।
অনেক সময় সঙ্গ দোষেও মানুষ ধারকর্জ করেন। যাঁদের সঙ্গে মিশছেন, তাঁরা যদি পানির মতো টাকা খরচে অভ্যস্ত থাকেন, তাহলে আপনারও সেই অভ্যাস তৈরি হবে। আপনি খুব বেশি সংযত হয়ে চললেও মাঝেমধ্যে যেটা খরচ করবেন, সেটাই আপনাকে দেনার দায়ে ডোবাতে পারে। তাই যাঁরা আর্থিকভাবে সচেতন, তেমন মানুষের সঙ্গে মিশুন, পরামর্শ নিন। অনলাইন বা অফলাইনে যেসব গ্রুপ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা করে, পরামর্শ দেয়, সেখানে যোগ দিতে পারেন।
সূত্র: রেড অনলাইন ও ইয়াহু ফিন্যান্স