গ্রে’স অ্যানাটমি সিরিজে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছিলেন কানাডীয়-মার্কিন অভিনেত্রী স্যান্ড্রা ও। এমি, গোল্ডেন গ্লোবসহ বেশ কিছু পুরস্কার আছে তাঁর ঝুলিতে। ১৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।

আমি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি। তবে এমন চরিত্রে অভিনয় করেছি, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। আমাকে ডিগ্রি দেওয়ার মাধ্যমে আপনারা আমার মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করলেন, ধন্যবাদ। তা-ও আবার ডক্টরেট! জানি, এটা সম্মানসূচক।
ফোনে আমাকে প্রস্তাবটা যখন দেওয়া হয়েছিল, ভাবলাম তোমাদের সঙ্গে দেখা করার দারুণ একটা সুযোগ! কিন্তু তারপরই মনে হলো, হায় ঈশ্বর, সেখানে আমি কী বলব!
গত বছর ফেদেরারের বক্তৃতা কত ভালো ছিল। কোনান ও’ব্রায়ানের মতো মজার কথাও তো বলতে পারি না। বা মিন্ডি কালিং। তাঁর অর্জনের তালিকা দেখলেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।
আমন্ত্রণ পাওয়ার পর থেকে প্রতি রাতেই তোমাদের কথা ভেবেছি। বুঝতে পারছিলাম, যা-ই বলি না কেন, আমাকে আজ সৎ থাকতে হবে।
যদি নিজের জীবন থেকে কিছু বলতে হয়, তাহলে একটা কথাই বলব। অস্বস্তির মধ্যে যদি থাকো, তাহলেই সবচেয়ে বেশি শিখতে পারবে। অর্থাৎ অস্বস্তিকে এড়িয়ে না গিয়ে যদি এর সঙ্গেই থাকতে শিখে যাও; বিশ্বাস করো—হয়তো এমন কিছু পাবে, যা কল্পনাও করোনি। যেখানে তুমি স্বচ্ছন্দ নও, সেই পরিস্থিতিই তোমার ভেতরে একধরনের শক্তি গড়ে তুলতে পারে, যা তোমাকে জীবনের মূল্যবোধ ধরে রেখেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে।
তোমরা অনেকেই জানো, আমি গ্রে’স অ্যানাটমি সিরিজের ১০টি সিজনে ড. ক্রিস্টিনা ইয়াং চরিত্রে অভিনয়ের বিরাট সুযোগ পেয়েছিলাম। এ সুযোগ আমাকে অর্থনৈতিক স্থিতি, খ্যাতি আর বিশেষ সুবিধা এনে দিয়েছিল।
কিন্তু এটিই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দশক। সেই সময় গভীর কিছু শিক্ষা পেয়েছিলাম, কারণ এর অনেক কিছুই ছিল অস্বস্তিকর। যখন কাজটা শুরু করি, বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। জানতাম সিরিজে কী কী আছে। কিন্তু কী আসতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না।
আমার অনেক চাওয়া ছিল। নিজের কাছে তো বটেই, সিরিজের লেখকদের কাছেও। যদি চিত্রনাট্যে কোনো কিছু বেমানান লাগত, রীতিমতো লড়াই করতাম। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম, ক্রিস্টিনা চরিত্রটার প্রতি আমারও কিছু দায় আছে।
মনে আছে সিরিজের ষষ্ঠ সিজনে লেখকদের সঙ্গে চিত্রনাট্য নিয়ে আমার একটা গন্ডগোল বেধে গেল। এতটাই যে বড় বসকে ফোন করতেই হলো। সেদিন (গ্রে’স অ্যানাটমি সিরিজের প্রধান লেখক ও নির্বাহী প্রযোজক) শন্ডা (রাইমস) বলেছিল, ‘স্যান্ড্রা, এমন তো আগেও হয়েছে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। একটা না একটা কিছু হবে—তুমি শুধু সংলাপ আওড়ে যাও।’
আমি শন্ডাকে বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ, ভেতরে-ভেতরে আমরা দুজনে একই জিনিস চাইতাম—একটা দারুণ শো। হ্যাঁ, অস্বস্তিটা সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়নি ঠিক। কিন্তু ‘অস্বস্তি’র সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বদলাতে শুরু করেছে। বুঝতে শুরু করেছিলাম, এটা দারুণ কিছু তৈরির প্রক্রিয়ারই একটা অংশ।
এভাবেই আমি আমার অস্বস্তিকে গ্রহণ করলাম। তখন নতুন কিছু বেরিয়ে এল। যা শুধু আমার নয়, শুধু লেখকদেরও নয়। বরং আরও সমৃদ্ধ কিছু, যা আমাকে চরিত্র হিসেবে, অভিনেত্রী হিসেবে, আর সহকর্মী হিসেবে আরও গভীরভাবে নিজেকে বুঝতে সাহায্য করেছে।
এখন বুঝি, অস্বস্তিটাই আদতে সুযোগ। কীভাবে তুমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাও, কীভাবে নেতৃত্ব দিতে চাও, কেমন মানুষ হতে চাও—তা অনুশীলন করার সুযোগ।
জীবন অনেক সময় এমনভাবে তোমাকে চ্যালেঞ্জ করবে, যেটা আগে থেকে তুমি অনুমানও করতে পারবে না। অনেক কিছুই ঘটবে, যেগুলো একেবারেই তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গ্রে’স অ্যানাটমি করার সময় আমার ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছিল। বিরতিহীন শিডিউলের চাপ আমাকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছিল, অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। শারীরিক আর মানসিক—দুই দিক থেকেই সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। আগে যেভাবে মানসিক আর শারীরিক অস্বস্তি জোর করে সহ্য করে গেছি, একসময় সেটা আর কাজ করছিল না। কারণ দেখা গেল, বিষণ্নতাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ‘প্যানিক অ্যাটাক’ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না।
কিন্তু ‘শো মাস্ট গো অন’। জীবন তো তোমার জন্য থেমে থাকবে না। যত বেশি চাইতাম বাইরের পরিস্থিতি বদলাক, তত খারাপ লাগত। কিছুটা স্থিতি ফিরতে শুরু করল, যখন আমি বাইরে না তাকিয়ে নিজের ভেতরে তাকালাম।
তুমি হয়তো এখন একেবারে সুস্থ, সেটাই আমার প্রত্যাশা, তবু বাজি ধরে বলতে পারি, তুমিও এমন কিছু নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছ, যা তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই। হয়তো তুমি চাকরি পাবে কি না, সেটা নিয়ে চিন্তিত। অথবা বন্ধুদের থেকে দূরে চলে যাবে, এই ভাবনা তোমাকে ভোগাচ্ছে। নাগরিক অধিকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়া, পৃথিবীজোড়া অশান্তি-হানাহানি—সবকিছু রোবটের দখলে চলে যাওয়া, অনেক কিছু নিয়েই দুর্ভাবনায় থাকতে পারো। হয়তো তুমি মরিয়া হয়ে পরিবর্তন আনতে চাইছ, কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে জানো না।
যে কারণেই অস্বস্তিতে থাকো না কেন, এর সঙ্গে লড়াই করার অন্যতম উপায় হলো—একে গ্রহণ করে নেওয়া। চাইলে তুমি অস্বস্তির সঙ্গে থাকার ছোট ছোট অনুশীলনও করতে পারো। আমি যেমনটা করি। আমার ক্ষেত্রে অনুশীলনের একটা উপায় হলো—নীরবতায় ডুবে যাওয়া। নিজের সঙ্গে সময় কাটানো।
মানে নিজের সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা, যেটা তাৎক্ষণিক ভাবনা বা অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল নয়। কেবল প্রতিক্রিয়া দেখানো নয়। আমরা যদি প্রতিনিয়ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকি, তাহলে আদতে সব সময়ই বিভ্রান্তি আমাদের ঘিরে থাকে।
নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হও। অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হও। যাঁর সঙ্গে তুমি একমত নও, তাঁর প্রতিও হও।