হাতব্যাগে ঝুলাছে চীনা পুতুল লাবুবু
হাতব্যাগে ঝুলাছে চীনা পুতুল লাবুবু

চীনা পুতুল লাবুবু সারা বিশ্বে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কেন

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন থেকে আরব আমিরাতের মতো দেশে একটা পুতুলের জনপ্রিয়তা যখন পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়, বাংলাদেশে বসে মনে তখন প্রশ্ন আসে—কী আছে এই পুতুলে?

গত বছরের শেষ থেকেই দেখা যাচ্ছিল হাতব্যাগের সঙ্গে অনুষঙ্গ ঝোলানোর ধারা। ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘ব্যাগ চার্মস’। এ ক্ষেত্রেও বিশ্বখ্যাত ফরাসি ব্র্যান্ড ‘আরমেস’ পিছিয়ে নেই। গত বছর আরমেসের ঘোড়া আর ছোট্ট আকারের বাড়ি, যেসবের দাম কয়েক লাখ টাকা, বিক্রি হয়েছে দেদার। ব্যাপারটা যেন এমন, এই ব্যাগ চার্মস আপনার স্ট্যাটাসের প্রতীক। কে কতটা শৌখিন, তার প্রকাশ যেন এই ঘোড়া আর বাড়ি। এ ধারায় এবার বাজিমাত করল ‘লাবুবু’ নামের এক চীনা পুতুল। দেখতে খানিকটা ভীতিকর। পুতুলগুলো কেনার জন্য গভীর রাত থেকে দোকানের বাইরে সার বেঁধে দাঁড়াচ্ছে হাজারো মানুষ। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন থেকে আরব আমিরাতের মতো দেশে একটা পুতুলের জনপ্রিয়তা যখন পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়, বাংলাদেশে বসে মনে তখন প্রশ্ন আসে—কী আছে এই পুতুলে?

লাবুবুর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ‘আনবক্সিং’ ভিডিওগুলোর বড় একটা ভূমিকা আছে। পুতুলটির উৎপাদক চীনা কোম্পানি পপ মার্ট। তাদের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, লাবুবু পাওয়া যায় ‘ব্লাইন্ড বক্স’-এ, অর্থাৎ বাক্সটি খোলার আগে ভেতরে কী আছে, তা থাকে অজানা। এই রহস্য বলুন বা চমকই মূলত আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এটাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এই পুতুলগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একধরনের ‘হ্যাপিনেস জেনারেটর’, মানে মনে সুখ বা আনন্দ তৈরি করে। এসবের মধ্যে আছে একধরনের ‘সেলফ-হিলিং’ প্রভাবও।

লাবুবুর উৎপত্তি চীনের হংকংয়ে

২০২৩ সালে সফট টয় বা প্লাশ ডল হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও গত এক বছরে অশুভ চেহারার লাবুবু পুতুল হুলস্থুল ফেলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। এখন তো অবস্থা এমন, দামি ব্র্যান্ডের ব্যাগের সঙ্গে ঝুলতে থাকা এই খুদে দানবদের দেখা মিলছে নানা ফ্যাশন শো কিংবা শহরের রাস্তাঘাটেও। হুঁশ হারিয়ে লাবুবু কেনার আরেকটি কারণ রিয়ানা, ডুয়া লিপা, ব্ল্যাকপিঙ্কের লিসা থেকে শুরু করে ডেভিড বেকহ্যামের ব্যাগেও দেখা গেছে এই পুতুল। বলতে গেলে তারকারা লাবুবু–জ্বরের ভাইরাস ছড়িয়েছেন।

এর প্রভাব পড়েছে ব্যবসায়ও। ২০২৪ সালে পপ মার্টের আয় দ্বিগুণের বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু সফট টয় বা প্লাশ ডলের বিক্রি বেড়েছে ১ হাজার ২০০ শতাংশের বেশি! মার্কিন বাজারে প্রতিটি লাবুবু পুতুলের দাম যদিও মাত্র ২০–৩০ ডলারের মধ্যে। সমস্যা হচ্ছে চাহিদার কারণে এখন আসল লাবুবু পুতুল পাওয়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুশকিল। এক লাবুবু সংগ্রাহক বলেছেন, ‘আসল লাবুবু পেতে হলে পপ মার্টের ওয়েবসাইটে যখনই নতুন চালান ছাড়বে, সেখানে লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে লড়তে হবে। অথবা সামনাসামনি দোকানে গিয়ে অন্য পাগল গ্রাহকদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করতে হবে।’

আগেই বলেছি, এই পুতুলের বিশেষ আকর্ষণ হলো এসব পাওয়া যায় ‘ব্লাইন্ড বক্স’-এ। মানে কোন পুতুলটি আপনি পাচ্ছেন, তা খোলার আগপর্যন্ত রহস্য। একেকটা বাক্সের দাম ২০-৩০ ডলার, আপনি পাবেন মাত্র একটি পুতুল। যদি নির্দিষ্ট কোনো চরিত্রের খোঁজে থাকেন, তাহলে একের পর এক বাক্স কিনতে হবে। প্রতিটি বাক্সের ভেতর কোন লাবুবু আছে, তা জানার অপেক্ষায় অনলাইনে একটি প্রাণবন্ত কমিউনিটিও গড়ে উঠেছে, যেখানে লোকেরা নিজেদের সংগ্রহ ছবি ও তথ্য ভাগাভাগি করেন; এক্সচেঞ্জ বা বিনিময়ও চলে সেখানে।

(শিশুরা সাধারণত দু-তিন বছর বয়সে পুতুল খেলতে শুরু করে, আর এসব খেলনা থেকে সরে আসে কৈশোরের আগে-পরে। এটা একধরনের মানসিক বিকাশের স্বাভাবিক ধারা। কিন্তু যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পুতুল বগলদাবা করে ঘোরে, তাহলে সেটা ‘ডিজনি অ্যাডাল্ট’ শ্রেণির সঙ্গে মিলে যায়।)

লাবুবু আসলে কী

লাবুবুর উৎপত্তি চীনের হংকংয়ে। তবে ‘হ্যালো কিটি’ বা অন্যান্য পরিচিত প্লাশ ডলের চরিত্রদের মতো নয়, লাবুবু চরিত্রগুলোকে বর্ণনা করা হয় ‘এলভিশ’ বা জাদুকরি প্রাণী হিসেবে। নর্ডিক পুরাণ অবলম্বনে চিত্রগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লাবুবু তৈরি করেছেন শিল্পী কাসিং লুং। বইটি প্রকাশের পর চীনা খেলনা কোম্পানি পপ মার্ট ২০১৯ সালে প্রথম সংগ্রহযোগ্য লাবুবু ফিগার বাজারে আনে। সেই থেকে শুরু হয় এই পুতুলের উত্থান। নতুন নতুন সংগ্রহ বাজারে আনার পর বিক্রিও বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। লাবুবু আদতে একটা পুতুল নয়, একদল চরিত্র। যাদের একসঙ্গে বলা হয় ‘দ্য মনস্টারস’। এই দলে আরও আছে জিমোমো, মোকোকো, টাইকোকো প্রমুখ। লাবুবুকে আলাদা করে তোলে এর বড় বড় চোখ, গা ভর্তি লোম আর মুখভর্তি নয়টি তীক্ষ্ণ দাঁত। প্রতিটি নতুন সংগ্রহে লাবুবুর পোশাক, মুখাবয়ব ও অনুষঙ্গ বদলে যায়, যে কারণে কেনার ঝোঁক বেড়ে যায় আরও। গুগল ট্রেন্ডস অনুযায়ী, গত এক মাসেই গুগলে লাবুবু–সংক্রান্ত তথ্য খোঁজা হয়েছে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন বার!

লাবুবু যখন প্রথম বাজারে আসে, তখন থেকেই এটি একের পর এক থিমভিত্তিক সংগ্রহ তুলে ধরেছে। নিচে কিছু জনপ্রিয় ও আলোচিত সিরিজ তুলে ধরা হলো—

লাবুবুর মূল বা ক্ল্যাসিক রূপ এটি

দ্য মনস্টারস ক্ল্যাসিক সিরিজ

লাবুবুর মূল বা ক্ল্যাসিক রূপ এটি। দাঁত বের করা হাসি, চোখে দুষ্টামির ঝিলিক, এখান থেকেই লাবুবুর যাত্রা শুরু।

লাবুবু ইনটু এনার্জি সিরিজ ২০২৫

চোখধাঁধানো নিয়ন রঙের সিরিজটি বিক্রি হয়েছে অতিদ্রুত। এই সংগ্রহে ছিল সিসি (হলুদ রঙের), হিহি (ধূসর রঙের), বাবা (হালকা বাদামি রঙের), জিজি (বেগুনি রঙের), কুয়ু (সবুজ রঙের), ডাডা (গোলাপি রঙের), ডুয়োডুয়ো (বাদামি গায়ে লাল নাক)।

লাবুবু ইনটু এনার্জি সিরিজের পুতুল
এখন পর্যন্ত ৩০০টির বেশি ধরনের লাবুবু বাজারে এসেছে। লাবুবু প্লাশ পেনড্যান্টগুলো এখন ব্যাগ চার্ম হিসেবে বেশ পরিচিত। এর প্রথম সিরিজ ‘দ্য মনস্টারস–টেস্টি ম্যাকারনস ভিনাইল ফেস ব্লাইন্ড বক্স’ (‘ভি ওয়ান’ নামে পরিচিত) বাজারে আসে ২০২৩ সালের অক্টোবরে। এরপর ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আসে দ্বিতীয় সিরিজ ‘দ্য মনস্টারস–হ্যাভ আ সিট ভিনাইল প্লাশ ব্লাইন্ড বক্স’ বা ‘ভি টু’। ‘ভি ওয়ান’ ও ‘ভি টু’ সিরিজের সংস্করণের পাশাপাশি একটি ‘সিক্রেট’ সংস্করণও আছে, যা বেশ বিরল। আর বিরল মানেই তো সংগ্রাহকদের উত্তেজনা। বর্তমানে টিকটকে হ্যাশট্যাগ লাবুবু ব্যবহার করে পোস্ট হয়েছে ১২ লাখের বেশি। পপ মার্টের সর্বশেষ লাবুবু ব্লাইন্ড বক্স সিরিজ ‘লাবুবু দ্য মনস্টারস: বিগ ইনটু এনার্জি বাজারে এসেছে গত এপ্রিলে। আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে গেছে প্রায় প্রতিটি দোকান থেকে। লাবুবু, জিমোমো ও মোকোকো—সিরিজের সব ফিগার সংগ্রহ করতে চাইলে খরচ করতে হবে অন্তত ৯ হাজার ডলার।

ফল ইন ওয়াইল্ড সিরিজ

প্রকৃতিপ্রেমী লাবুবুদের নিয়ে এই সিরিজ। ডিজাইনে ছিল বাকেট হ্যাট, ওভারঅল, রেইন বুট। এই সিরিজ তুমুল জনপ্রিয়তা পায় যখন থাই র‍্যাপার, গায়িকা, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী লালিসা মনোবালকে (লিসা) একটি ফল ইন ওয়াইল্ড লাবুবু বহন করতে দেখা যায়।

লাবুবু টাইম টু চিল

আরামপ্রিয় লাবুবু ছিল এই সংগ্রহে। নানা ধরনের আরামদায়ক পোজ তুলে ধরা হয়।

লাবুবু টাইম টু চিল

লেটস চেকমেট সিরিজ

চেস বা দাবা থিমে তৈরি লাবুবু।

ম্যাকারন সিরিজ

মিষ্টি ফরাসি ডেজার্ট ম্যাকারনে অনুপ্রাণিত সিরিজ।

প্যাস্টেল কালার

নরম, মিষ্টি রঙের পোশাক ও মুড তুলে ধরা হয় এই সংগ্রহে। সিরিজটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারদের মধ্যে।

রিজিওনাল এক্সক্লুসিভ এডিশনস

বিশেষ দেশভিত্তিক লাবুবু সংগ্রহ।

সূত্র: ইনডিপেনডেন্ট, ভোগ বিজনেস, গার্ডিয়ান, গালফ নিউজ ও টুডে