পরিবারে নারীর অসুস্থতাকে প্রায় সময়ই অবহেলা করা হয়, চিকিৎসা শুরুই হয় দেরিতে, ফলে রোগের জটিলতা বেড়ে যায়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়াও নারীর গুরুত্ব না পাওয়ার একটি বড় কারণ। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য নারীশিক্ষা, সচেতনতা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি।
নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, অনেক সময়ে চাইলেও গর্ভনিরোধ করার অধিকার পাচ্ছেন না তাঁরা, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ মেনে নিতে হচ্ছে তাঁদের। দেশের ৩০ শতাংশ নারী কখনো প্রজননসংক্রান্ত সমস্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।
নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর ‘নারীস্বাস্থ্য ও মাথাব্যথা’ শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার গতকাল মঙ্গলবার ছিল দ্বিতীয় পর্ব। গতকালের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘নারীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতেও প্রয়োজন লিঙ্গসমতা’। সেখানে এসব কথা বলেন আলোচকেরা। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘লিঙ্গ সমতার মধ্য দিয়েই পৃথিবীর টেকসই আগামীকে অর্জন করা সম্ভব’।
এসকেএফের সৌজন্যে আয়োজিত ওই আলোচনা অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন সুস্মিতা শ্রুতি চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ওজিএসবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম, জেড এইচ সিকদার ওমেনস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফাতেমা রহমান এবং প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজনীন আহমেদ। তাঁদের সঙ্গে এই আলাপচারিতায় নারী দিবসের মূলমন্ত্র এবং বাংলাদেশে এই সময়ের নারীর সার্বিক অবস্থার বিষয়গুলো উঠে আসে।
ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরিন বলেন, একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান ভূমিকা ও অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই অধিকার ও সমতার জায়গাটি যুগ যুগ ধরে ব্যাহত হয়েছে নানাভাবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারীরা কোন কোন বাধার সম্মুখীন হন এবং আমাদের দেশের নারীরা সেদিক দিয়ে কেমন অবস্থানে আছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ফাতেমা রহমান বলেন, সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও রাষ্ট্র পরিচালনা, জ্ঞানবিজ্ঞান, চিকিৎসা, বিচারকাজ, শিক্ষা—সব ক্ষেত্রেই নারী আজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছেন; বাধা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে আছে শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়া, বাল্যবিবাহ, ঘরে-বাইরে নিপীড়ন ও সহিংসতা ইত্যাদি। এ ছাড়া চিকিৎসক হিসেবে তিনি তুলে ধরেন আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যেমন নারীর অপুষ্টি , উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব বা এসবের প্রতি অবহেলা, প্রজনন ক্ষমতাকেন্দ্রিক অধিকারহীনতা অর্থাৎ কখন গর্ভধারণ করবেন বা কোথায় বাচ্চা প্রসব হবে ইত্যাদি। ফাতেমা রহমান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এদেশে এমন মৌলিক অধিকারগুলো নারীদের ক্ষেত্রে সব সময় নিশ্চিত করা যায় না।
এগিয়ে যাওয়ার পথে নারীর সুস্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ডা. নাজনীন আহমেদ বলেন, একজন নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে তিনি কখনো কোনো কাজই ভালোভাবে করতে পারবেন না; তা তিনি যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন। জন্ম থেকেই এ জন্য মেয়েশিশুর সঠিক পুষ্টি ও যত্ন প্রয়োজন। বয়ঃসন্ধির সময়ে তার আরেক ধরনের যত্ন দরকার, যাতে পরিণত বয়সে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ সম্পূর্ণভাবে শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত হয়। ডা. নাজনীন বলেন, এগিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সুস্থতাও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে একজন নারী কীভাবে বেড়ে উঠছেন, তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কেমন, এ ব্যাপারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মাসিকের কারণে মেয়েদের অগ্রযাত্রায় কী কী বাধা আসতে পারে, এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ডা. জিন্নাত আরা নাসরিন বলেন, স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতি মাসে পিরিয়ড হয়। পিরিয়ড চলাকালে যে মাথাব্যথা বা পেটব্যথা হয়, তা টাফনিলের মতো কোনো নন-স্টেরয়েড ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণ করলেই সহনীয় পর্যায়ে থাকে। তবে স্বাভাবিক পিরিয়ডের সময়ে প্রচণ্ড ব্যথা-বেদনা হলে তা এন্ডোমেট্রোসিসের মতো জটিল রোগের লক্ষণ হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রয়োজন।
এ পর্যায়ে ডা. নাজনীন আহমেদের কাছে মেয়েদের খাওয়াদাওয়া, ব্যায়াম ও জীবনযাপনের সঙ্গে পিরিয়ডের সমস্যাগুলোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, রক্তস্বল্পতার কারণে পিরিয়ডের সময়ে মাথাব্যথা বেড়ে যেতে পারে। আয়রন–সমৃদ্ধ খাবার ও সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করলে এই ব্যথা অনেকটাই কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। সঠিক ব্যায়াম যেমন যোগব্যায়াম, অ্যারোবিকস, গানের তালে নাচ ইত্যাদি শরীরের পেশির সংকোচন-প্রসারণকে স্বাভাবিক করে, মস্তিষ্কের জন্যও আরামের অনুভূতি দেয়। তাই এভাবেও পিরিয়ড চলাকালে মাথাব্যথা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ ছাড়া হরমোন কমবেশি হওয়া প্রতিরোধ করতে পারে, এমন খাবার খাদ্যতালিকায় রাখলেও মাইগ্রেন ও পিরিয়ডকালীন পেটব্যথা ও মাথাব্যথা কম রাখা সম্ভব।
এ পর্যায়ে যুক্ত হন অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম। তাঁকে আলোকপাত করতে বলা হয় প্রি-মেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম (পিএমএস) বা মাসিকের আগে আগে বা মাসিকের মাঝামাঝি সময়ে শরীরে যেসব সমস্যা দেখা যায় সেই সম্পর্কে। এই পিএমএসের বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে ফেরদৌসি বেগম বলেন, পিরিয়ডের আগে আগে বিরক্ত লাগা, মেজাজ খারাপ, বিষণ্নতা, শরীরে পানি আসা, স্তনের প্রদাহ, অস্থির লাগা, মাথাব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। এসব সমস্যা আসলে কয়েকটি হরমোনের কমবেশির কারণে হয়ে থাকে। এ সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে একটি অত্যন্ত ভালো ও সুশৃঙ্খল জীবনপদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি জানান। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক সময়ে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া এসবের কিছু চিকিৎসা রয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ও জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধে এসব সমস্যার প্রতিকার সহজেই মেলে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও অতিরিক্ত সমস্যা দেখা দিলে পরীক্ষা–নিরীক্ষাসহ সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মেয়েরা কোন কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন? এমন প্রশ্নে ডা. ফাতেমা রহমান বলেন, মাসিকের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি। বাল্যবিবাহের শিকার এবং অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতায় ভোগা অল্পবয়সী গর্ভবতী ও প্রসূতিরা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে প্রসবপরবর্তী জটিলতাও অত্যন্ত বেড়ে যায়। প্রসবপরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ প্রসূতির মৃত্যুর একটি বড় কারণ। পরে বয়স বাড়লে জরায়ুমুখের ক্যানসার, টিউমারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের ব্যাপারেও দ্রুত পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে সংকোচ ও অনীহা দেখা যায়। এতে জটিলতা বেড়ে যায় বহু গুণ। অস্টিওপরোসিসসহ মেনোপজকেন্দ্রিক সমস্যাগুলোও সঠিক চিকিৎসার ফলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
এ সময় দাঁড়িয়ে সামগ্রিকভাবে নারী হিসেবে কী কী সহযোগিতা আমরা আশা করতে পারি, এমন এক প্রশ্নে ডা. শেখ জিন্নাত আরা নাসরিন বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পারিশ্রমিক ও পদমর্যাদায় সমতা আদায় করতে হবে সর্বস্তরে। কন্যাশিশুর পুষ্টি, বাল্যবিবাহ রোধ, শিক্ষালাভের অধিকার এসব বিষয় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রজননের অধিকারের বিষয়গুলোতে নিজে সিদ্ধান্ত দিতে পারা, স্বাবলম্বী হওয়া—সব ক্ষেত্রেই নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে ডা. ফেরদৌসি বেগম নারী দিবসের গুরুত্ব এবং নারীর অগ্রগতিতে নারীর সুস্বাস্থ্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। ডা. ফেরদৌসি বলেন, প্রতিটি দিন নারী দিবস কারণ, সব নারী প্রতিদিন ঘরে-বাইরে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর মতে এই দিবসের মূল কথাই হচ্ছে, নারীর মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়ে বক্তব্য রাখা। দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, নারীর সম–অধিকার আগেও ছিল না, এখনো নেই; বরং দিন দিন নারীর প্রতি অবমাননা ও সহিংস আচরণ বেড়েই চলেছে।
দেশের ৩০ শতাংশ নারী কখনো প্রজননসংক্রান্ত কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না উল্লেখ করে ডা. ফেরদৌসি বলেন, একজন গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের যত্ন নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ৫০ শতাংশ প্রসব অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাড়িতে হচ্ছে। করোনাকালে বহু কিশোরীর বাল্যবিবাহ হয়েছে, অন্য সময়েও বখাটেদের উৎপাতে বিদ্যালয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের। এসব বিষয় ভালোভাবে সবার কাছে পৌঁছে দিতে নারী দিবসের অপরিসীম গুরুত্ব আছে বলে তিনি মনে করেন।