সুস্থ দেহের সঙ্গে সুস্থ মন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এগুলোর মধ্যে কোনো একটির অনুপস্থিতিই সার্বিক সুস্থতাকে ব্যাহত করে। এ ক্ষেত্রে অবহেলা করলে পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এই লক্ষ্যে ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে এসকেএফের পৃষ্ঠপোষণায় অনুষ্ঠিত হয় মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘যত্নে রাখি মনচিঠি’র তৃতীয় ও শেষ পর্ব। ডা. তানিয়া আলমের সঞ্চালনায় এই পর্বে অতিথি ছিলেন মনোরোগ ও যৌন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শামসুল আহসান মাকসুদ। আলোচ্য বিষয় ছিল: সুস্থ মন, সুস্থ দেহ।
অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং এসকেএফের ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়।
ডা. মো. শামসুল আহসান মাকসুদ বলেন, বর্তমানে কোভিড-১৯–এর প্রাদুর্ভাবে শারীরিক স্বাস্থ্যই যেখানে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা আরও দুরূহ হয়ে পড়ছে। এ জন্য আমাদের শুধু শারীরিক কিংবা মানসিক নয়, বরং সার্বিক সুস্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, সুস্থতা বলতে কিন্তু কেবল শারীরিক কিংবা মানসিক সুস্থতা বোঝানো হয় না। একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং অন্য যেসব প্যারামিটার আছে—সবকিছু মিলেই সার্বিক সুস্থতা বিবেচনা করা হয়। একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য যদি ভালো না থাকে, তাহলে তাঁর শারীরিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে না।
মানসিক রোগকে আমরা সাধারণত দুটি দাগে চিহ্নিত করতে পারি। একটি হলো জটিল মানসিক রোগ। এ অবস্থায় অনেকে কানে গায়েবি আওয়াজ শোনেন, সন্দেহবাতিক থাকেন, আবার ভাঙচুর বা মারামারি করেন, কিংবা মনে করেন যে সবাই তাঁর ক্ষতি করবে। আরেক ধরনের মানসিক রোগ হলো মাইনর মানসিক রোগ; যেমন বর্তমানে অতিমারির কারণে বাড়ির বাইরে যেতে অনেকের অতিরিক্ত ভীতি কাজ করে। নিজে কিংবা পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে স্বাভাবিক কাজকর্মে যখন কেউ বাধাগ্রস্ত হন, সেটিও এর অন্তর্ভুক্ত। আবার যেকোনো ধরনের মাদকাসক্তিও মানসিক রোগের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত বা নিগৃহীত হলে কর্মদক্ষতা কমে যায় এবং মানসিক ক্ষমতা ব্যাহত হয়। আবার যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবরে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এখন যেটা হচ্ছে ধর্ষণের খবরে।
২০ বছর আগে মানুষ যে রকম স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেন, এখন কিন্তু তেমনটি হচ্ছে না; বরং অনেক বেশি মানসিক এবং শারীরিক চাপ নিয়েই জীবন যাপন করছেন। নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চাপও বেড়ে যাচ্ছে। আমরা এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে কারও সঙ্গে অবিচার হবে না। যদি ভালো কাজের মূল্যায়ন এবং খারাপ কাজের শাস্তিস্বরূপ মানুষকে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে অন্যায়-অবিচার যেমন দূরীভূত হবে, তেমনি স্বাভাবিক কাজকর্মে কেউ বাঁধাগ্রস্ত না হওয়ার কারণে মানসিক চাপও কমে যাবে।
মানুষ খুব বেশি মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে আমরা রিল্যাক্সেশন বা হালকা ব্যায়ামের পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিছু কিছু আচরণ বা সহিংসতা শিশুদের দেখা উচিত নয়। তাদের কোমল মনকে আহত করে এমন কিছু দেখানো যাবে না, যেমন অনেক সময় শিশুরা নৃশংস হত্যাকাণ্ড টিভি বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তবে পরিবারের উচিত শিশুর মানসিক অবস্থা বুঝে ভালো ও মন্দ দিক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। আর শিশুরা যেহেতু অনুকরণপ্রিয়, তাই ভালো কাজ ও ভালো আচরণের মাধ্যমে তাদের সুশিক্ষা দিতে হবে।
আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে গ্রাস করে চলেছে মাদক। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগই কৌতূহলবশত মাদক সেবন করে এবং পরে এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। অনেকে আবার বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়েও নেশাগ্রস্ত হয়। মাদকে আসক্ত হওয়ার একটি কারণ হলো নেশার ফলে মস্তিষ্কে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, সেটি তাদের ভালো লাগে। পরবর্তী সময়ে যখন সে মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন মাদক সেবন না করা পর্যন্ত তাদের নানা রকম শারীরিক অসুস্থতা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। কেউ যখন মাদকাসক্ত হন, তখন তাঁদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামের এক ধরনের কেমিক্যাল নিঃসরণ হয় এবং তাঁরা এমন আচরণ করেন, যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। অপর দিকে কেউ যখন পাহাড়ে উঠছেন, তখনো তাঁর মস্তিষ্কে সেই ডোপামিনই নিঃসরণ হয়ে থাকে—তখন কিন্তু সেটা স্বাস্থ্যকর। তাই আমি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এ পদ্ধতি অবলম্বনের উপদেশ দিয়ে থাকি। এ জন্য তরুণসমাজকে মাদক থেকে বিরত রাখতে জিম ও সাইক্লিং করা কিংবা মাউন্টেনিয়ারিং বা ট্রেকিংয়ে ব্যস্ত থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
কোনো ব্যক্তি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে, সময়মতো চিকিৎসা পেলে সে সুস্থ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে অবহেলায় মারাত্মক ক্ষতিসাধন হতে পারে, যেমন অতিরিক্ত ডিপ্রেশনের বশবর্তী হয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করে বসেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ পূর্বেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এবং চিকিৎসকের কাছে এসেছেন। তাই কারও মধ্যে যদি আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে থাকে, তাহলে তাঁর সাইকিয়াট্রিক ইভালুয়েশন খুবই জরুরি।