আমাদের প্রতিদিনের খাবারে ডাল আর সবজি থাকেই। খাবারের শুরুতে সবজি আর শেষে ডাল খাওয়া অনেকের অভ্যাসও। কারণ, এটাই বাঙালির আদর্শ বা সুষম খাবার হিসেবে প্রচলিত। আমিষ, আঁশ, ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর এসব খাবার নিঃসন্দেহে দারুণ উপকারী। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, এ ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবারও অতিরিক্ত খেলে হতে পারে হিতে বিপরীত।
সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবারও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। অতিরিক্ত ডাল বা সবজি খাওয়াকে হয়তো বিপজ্জনক মনে হয় না, কিন্তু দীর্ঘ সময় এমন চলতে থাকলে হজমের সমস্যা, পুষ্টি শোষণে বাধা এমনকি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। কী কী সমস্যা হতে পারে, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
আমাদের দেশে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের প্রধান উৎস মানেই ডাল। মুগ, মসুর, মাসকলাই, ছোলা, অড়হর ডালে থাকে আয়রন, ফোলেট, পটাশিয়াম ও অ্যামিনো অ্যাসিডের মতো অনন্য পুষ্টি উপাদান।
প্রতিদিন এক বা দুই বাটি ডাল খেলে তা আমাদের পেশির স্বাস্থ্য, শক্তি এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে দারুণ সাহায্য করে।
কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডাল খাওয়ার ঝুঁকিও আছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষদের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বেশি পরিমাণ ডাল খান, তাঁদের ক্যানসারে মৃত্যুর ঝুঁকি ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
কিন্তু একই গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা বেশি পরিমাণ ডাল বা শুকনো শিমবীজ খান, তাঁদের হৃদ্রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
হজমে সমস্যা
ডালে প্রচুর ফাইবার বা আঁশ এবং প্রতিরোধী স্টার্চ বা রেজিস্ট্যান্স স্টার্চ থাকে। তাই ডাল অতিরিক্ত খেলে পেট ফাঁপা, গ্যাস বা বদহজম হতে পারে। বিশেষ করে ডাল রান্নার আগে ভালোভাবে না ভেজানো হলে এ ধরনের সমস্যা বেশি হয়।
পুষ্টি শোষণে বাধা
ছোলায় ফাইটেটস ও ল্যাকটিন বেশি থাকে। এসব বেশি খেলে আমাদের শরীর জিংক, আয়রন ও ক্যালসিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ শোষণ করতে পারে না। ফলে দেখা দেয় নানা সমস্যা।
আমিষের ভারসাম্যহীনতা
ডাল আমিষের দারুণ উৎস হলেও শস্য বা অন্যান্য খাবার না খেয়ে শুধু ডালের ওপর নির্ভর করলে শরীরে অ্যামিনো অ্যাসিডের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
তাহলে সমাধান কী? পুষ্টিবিদেরা প্রতিদিন এক থেকে দুই বাটি ডাল খাওয়ার পরামর্শ দেন। এর সঙ্গে ভাত বা রুটি খেলে প্রোটিনের ঘাটতি থাকে না। এ ছাড়া একেক দিন একেক রকম ডাল খেলে শরীর বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি পায়।
বায়োমেড সেন্ট্রাল বা বিএমসির এক গবেষণায় দেখা গেছে, সুষম খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত ফল ও সবজি থাকলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমে। কিন্তু একই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, পালংশাকের মতো উচ্চ অক্সালেটযুক্ত খাবার বেশি খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
সবজিকে আমরা প্রায় নির্দোষ খাবার মনে করি। মনে হয়, যত খুশি খাই, কোনো চিন্তা নেই! সবজিতে ক্যালরি কম, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও খনিজ থাকে প্রচুর। কিন্তু প্রতিদিন অতিরিক্ত সবজি খাওয়া ঠিক নয়। এতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হতে পারে।
হজমে সমস্যা
শরীরের জন্য আঁশজাতীয় খাবার অপরিহার্য। কিন্তু পালংশাক, শিম বা গাজরের মতো সবজি থেকে অতিরিক্ত আঁশ গ্রহণ করলে ডায়রিয়া, পেটব্যথা বা পুষ্টি শোষণে সমস্যা হতে পারে। বেশি আঁশ শরীরের হজমপ্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে।
থাইরয়েডের সমস্যা
বাঁধাকপি, ফুলকপি ও ব্রকলির মতো সবজিতে গয়ট্রোজেন নামে একধরনের উপাদান থাকে। খুব বেশি পরিমাণে খেলে এটি থাইরয়েডের সমস্যা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যাঁদের আগে থেকেই থাইরয়েডের সমস্যা আছে, তাঁদের সমস্যা আরও বাড়ে।
খনিজের ভারসাম্যহীনতা
পালংশাক ও বিটরুটের মতো কিছু শাকসবজিতে অক্সালেট বেশি থাকে। তাই এসব বেশি খেলে কিডনিতে পাথর তৈরি হতে পারে।
প্রতিদিন তিন থেকে চার ধরনের সবজি খান।
একসঙ্গে সবুজ, লাল ও হলুদ রঙের সবজি মিশিয়ে খেলে ভালো। এতে সব ধরনের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায়, আবার হজমেও সমস্যা হয় না।
মোটকথা, ডাল ও সবজি দুটোই অত্যাবশ্যক। কিন্তু সেসব খেতে হবে পরিমিত।
একটি নির্দিষ্ট খাবার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেলে অন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো বাদ পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
পুষ্টিবিদেরা জোর দিয়ে বলেন, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অর্থ ডাল বা সবজি বাদ দেওয়া নয়, বরং পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ এবং বৈচিত্র্য বজায় রাখা।
রান্নার পদ্ধতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডাল ভিজিয়ে রাখা, অঙ্কুরিত করা এবং সবজি হালকা ভাপে রান্না করে খেলে হজমক্ষমতা বাড়ে এবং পুষ্টিও পাওয়া যায় বেশি।
অন্যদিকে অতিরিক্ত সেদ্ধ বা রান্না করলে খাবারের ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়। তবে সঠিক পরিমাণ খেলে ডাল ও সবজিই আপনার সেরা বন্ধু হয়ে উঠবে।
সূত্র: মায়ো ক্লিনিক