শিশু–কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যে আমরা আদতে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তরের আগে আরেকটি প্রশ্ন ছুড়ে দিই। মানসিক স্বাস্থ্য মানে কী? অধিকাংশই বলবেন, ‘মানসিক রোগ না থাকা।’ কিন্তু এটি আরও অনেক বড় বিষয়। এটি ব্যক্তির আবেগীয়, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকা বোঝায়, যা প্রভাবিত করে তার চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণকে। অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক, চাপ মোকাবিলার দক্ষতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
শৈশবের পরের ধাপটাই কৈশোরকাল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বয়ঃসন্ধিকাল ১০ বছর বয়স থেকে শুরু করে ১৯ বছর পর্যন্ত চলে। সময়টা অফুরান প্রাণশক্তি, উদ্দাম আবেগ আর সীমাহীন সম্ভাবনার। সবকিছুতে কৌতূহল, শরীরে নতুন অনুভূতির রোমাঞ্চ, স্বাধীনচেতা মনোভাব অথবা বিদ্যমান নিয়মরীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা—এ রকম আরও অনেক বৈশিষ্ট্য কৈশোরকালকে করে তোলে অনন্য।
‘আমি কে, কী চাই, কীভাবে দেখব আমার জীবন’—আত্মপরিচয়ের এই অনুসন্ধানের পথ ধরেই কৈশোরের চারিত্রিক বিকাশ ঘটতে থাকে। মস্তিষ্কের দ্রুত স্নায়বিক বিকাশ ও হরমোনের প্রভাবে শরীরের যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনই মন দ্রুত বদলায়। এ বিকাশ নির্ভর করে তার জিনগত বৈশিষ্ট্য, পারিবারিক পরিবেশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চারপাশের ওপর।
শিশু–কিশোরের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে মানসিক সুস্থতার ওপর। আবার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চিন্তাপদ্ধতি, আবেগীয় রূপ ও সামাজিক ভূমিকা অনেকাংশেই নির্ধারিত হয় শৈশব ও কৈশোরকালীন মনের যত্নের ভিত্তিতে। আবেগের প্রবলতা, অনুসন্ধিৎসু মন, নিজেকে প্রকাশের চেষ্টা এ সময়কে যেমন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে, তেমনই অপরিপক্বতা ও ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা এই সময়কে করে তোলে নাজুক।
সারা বিশ্বে বর্তমান প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এক পরিবর্তনশীল ও অস্থির সময়ের সন্ধিক্ষণে। ভোগবাদী ব্যবস্থা নির্ধারণ করছে দৈনন্দিন জীবনযাপন, ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও সম্পর্ক। শক্তি আর প্রতিযোগিতার খেলায় সবাই জয়ী হতে চাইছে। আমদের ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাপদ্ধতি, এমনকি অনুভূতিও নিয়ন্ত্রণ করছে মুঠোফোন বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
শিশুরা বাস্তব জগতের বদলে মোহাচ্ছন্ন হয়ে বেড়ে উঠছে ভার্চ্যুয়াল জগতের অবাস্তব স্বপ্নমায়ায়। ছোটবেলা থেকেই পরিচিত হচ্ছে সাইবার ক্রাইম, সহিংস ভিডিও গেম, মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার মতো বিপজ্জনক বিষয়গুলোর সঙ্গে।
বর্তমান সময় শিশু–কিশোরদের মানসিক বিকাশে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে প্রযুক্তি ও সমাজ। জীবনকে সহজ করার নামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইকে মানুষের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এতে মানুষ থেকে দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে মানুষ। শিশু–কিশোরেরা বন্ধুদের সময় দেওয়ার বদলে সময় কাটাচ্ছে এআই বা অনলাইন গেমে। এতে সামাজিক মেলামেশা ও খেলাধুলা থেকে যে আবেগীয় গঠন ও জীবনদক্ষতা তৈরি হওয়ার কথা, তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায়। মানসিক রোগের ঝুঁকি উঠতি বয়সে সব সময় বেশি হলেও বর্তমান যুগের এসব উপাদান বাড়তি ঝুঁকি যোগ করছে।
এ ছাড়া বয়ঃসন্ধিকালীন শরীরের পরিবর্তন, বন্ধুদের প্রভাব, আত্মমর্যাদা, প্রেম, পরিবারের প্রত্যাশা, বাইরের জগতের বিভিন্ন আকর্ষণ কিশোরদের মধ্যে চাপ তৈরি করতে পারে। বাড়তি এই চাপ ঠিকমতো সামলাতে না পারলে মানসিক সমস্যার ঝুঁকি আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৫০ শতাংশ মানসিক রোগের শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের মধ্যে। সারা বিশ্বে ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু–কিশোর মানসিক রোগে ভোগে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জরিপ বলছে, বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ শিশু–কিশোর মানসিক রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ মাদকাসক্ত। ৯২ শতাংশ মানসিক রোগী চিকিৎসার আওতার বাইরে। এসব মানসিক রোগের মধ্যে বেশির ভাগই বিষণ্নতা বা উদ্বেগজনিত।
শিশু–কিশোরদের মানসিক রোগের হার এত বেশি হওয়ার পেছনে আছে তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য, অপরিপক্ব মানসিক গঠন এবং আর্থসামাজিক পরিবেশের জটিল মিথস্ক্রিয়া।
মানসিক রোগ নানা আচরণ ও শারীরিক উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এসব উপসর্গকে প্রায় সময় শিশু–কিশোরের আচরণগত সমস্যা বা শারীরিক অসুস্থতা হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। এই আচরণ বা শারীরিক উপসর্গ যে তাদের মনের জটিল অবস্থারই বহিঃপ্রকাশ, তা আমাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনার জন্য উপেক্ষিত থেকে যায়।
মানসিক উপসর্গ
অতিরিক্ত জেদ, অবাধ্যতা, খিটখিটে মেজাজ, ভাঙচুর করা।
পড়ালেখায় অমনোযোগ, পরীক্ষার ফলাফল খারাপ করা।
কারও সঙ্গে মিশতে না পারা, একা থাকা, স্কুলে যেতে না চাওয়া, পরীক্ষা বা সামাজিক ভীতি।
দুশ্চিন্তা, ভয়, অস্থিরতা, অল্পতেই কেঁদে ফেলা, মৃত্যুভয়।
নিজেকে আঘাত করা, আত্মহত্যার প্রবণতা।
অস্বাভাবিক কথা বলা, সন্দেহ, বিড়বিড় করে কথা বলা।
অস্থিরতা, অবাধ্যতা, মিথ্যা কথা বলার প্রবণতা।
মুঠোফোন বা মাদকে আসক্তি ইত্যাদি।
শারীরিক উপসর্গ
শ্বাসকষ্ট, বুকব্যথা বা বুকে চাপ বোধ করা, বুক ধড়ফড়, শরীর অবশ হয়ে আসা।
মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা, লেখার সময় হাত কাঁপা।
খেতে অনীহা, বমিভাব, খাবার গিলতে সমস্যা, পেটব্যথা।
অনিদ্রা, অতিরিক্ত ঘুম।
খিঁচুনি, অচেতন হয়ে পড়া, হাঁটতে না পারা, পরিচিতজনকে চিনতে না পারা।
বিছানায় প্রসাব করা।
এসব উপসর্গ দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব।
জরুরি বিষয় হলো, শিশু–কিশোরের মনের দিকে না তাকিয়ে শুধু তাদের আচরণের ওপর প্রতিক্রিয়া দেখালে বা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে সমস্যা কমবে না, বরং বাড়বে। সঠিক চিকিৎসা না হলে এসব সমস্যা তাদের সার্বিক বিকাশ, শিক্ষাগত এবং পরবর্তী সময়ে পেশাগত সাফল্য, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং সামগ্রিকভাবে ভালো থাকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রতিদিন সন্তানের সঙ্গে কিছু সময় কাটান। গুরুত্ব দিয়ে তাদের কথা শুনুন।
শিশু–কিশোরদের পড়ালেখার পাশাপাশি বয়স অনুযায়ী দায়িত্ব দিন।
খেলাধুলা, বন্ধুত্ব ও সামাজিক মেলামেশায় উৎসাহ দিন। এসব তার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।
সমালোচনা, গায়ে হাত তোলা, তুলনা করা থেকে বিরত থাকুন। এসব আচরণ সন্তানের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি করে।
জেদ বা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন। প্রয়োজনে প্রাপ্য সুবিধা সাময়িকভাবে কমিয়ে দিন।
শিশু–কিশোরদের ভালো আচরণের প্রশংসা করুন। আস্থা প্রকাশ করুন।
সীমারেখা নির্ধারণ করুন। মুঠোফোনের ব্যবহার শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করুন।
সন্তানের ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত মা-বাবা একসঙ্গে আলোচনা করে নিন।
সন্তানের যেকোনো চাহিদা সঙ্গে সঙ্গে না মিটিয়ে এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।
সন্তানের ব্যর্থতা বা ভুল সহজভাবে গ্রহণ করুন। মেনে নিন এবং মেনে নিতে শেখান।
কঠোর শাসন বা অতিরিক্ত প্রশ্রয় দুটিই এড়িয়ে চলুন। দৃঢ়তা ও সহমর্মিতার ভারসাম্য রাখুন।
স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের মানসিক রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
মানসিক রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য ইতিবাচক অভিভাবকত্ব–বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন।
পাঠ্যসূচিতে ‘স্কুল মেন্টাল হেলথ’ অন্তর্ভুক্ত করা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা।
বস্তি ও শরণার্থীশিবিরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদকবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা।
সামাজিক দক্ষতা ও খেলাধুলার গুরুত্ব বাড়ানো।
গণমাধ্যমে শিশু–কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
এবার একেবারে শুরুর প্রশ্নের প্রসঙ্গে আসা যাক। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শিশু–কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি বেশি উপেক্ষিত থাকে। অথচ আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে শিশু–কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
কারণ, শিশু–কিশোরদের সুস্থ মানসকাঠামো নির্ধারণ করবে আগামীর বৈষম্যহীন সমাজ, রাষ্ট্র ও আমাদের চারপাশ। আজকের কিশোর আগামীর মূল চালিকা শক্তি, অভিভাবক, নেতা ও দেশের নীতিনির্ধারক। তাই আজকের সঠিক পরিচর্যা আগামী দিনের আত্মবিশ্বাসী, স্বপ্নদর্শী প্রজন্ম তৈরি করবে।