রোজ সময়মতো অফিসে যাওয়া, সব কাজ ভালোভাবে শেষ করা, অফিসের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা—সব মিলিয়ে কর্মজীবনটা কখনো কখনো বেশ চাপের হয়ে উঠতে পারে। তুমুল প্রতিযোগিতার এই পৃথিবীতে কর্মীদের নানান দায়িত্ব দেন কর্তাব্যক্তিরা। সামলাতে হয় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। কখনো কখনো অফিসের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মীর ব্যক্তিগত জীবনেও ঢুকে পড়তে পারে অফিসের চাপ। কর্মীদের এত চাপে রাখলে কি অফিস আদতে লাভবান হয়?
যেকোনো অফিসের কর্তাব্যক্তি তাঁর কর্মীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কাজটা আদায় করে নিতে চাইতেই পারেন। তবে কাজটা যেন কর্মীর জন্য অতিরিক্ত হয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখাও জরুরি। নইলে কর্মী যেমন ভালো থাকবেন না, ভালো হবে না অফিসেরও। জেনে নেওয়া যাক এ সম্পর্কে।
অতিরিক্ত চাপ একজন ব্যক্তির দেহ ও মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তায় থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। পরদিনের কাজের শুরুটাই যদি সতেজ না হয়, তাহলে আরেক মুশকিল। হুট করেই কাজে হতে পারে ভুলভ্রান্তি।
দীর্ঘদিন অতিরিক্ত চাপে থাকলে অবসাদ গ্রাস করতে পারে কর্মীদের। মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে সহজেই। ফলে কাজের পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। অতিরিক্ত ক্লান্তি বা অবসন্নতা নিয়ে কাজ করলে সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করাটাও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কাজে দেরি হলে কিংবা ভুল হলে অফিসেরই ক্ষতি। তাতে অফিসের গ্রাহকেরাও অসন্তুষ্ট হন। অফিসের সুনাম হয় ক্ষুণ্ন।
একজন কর্মীর কাজের চাপ যখন অফিসের পরেও তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়, তখনো হতে পারে এমন সমস্যা। তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান-আয়োজনের মধ্যেও যখন অফিসের ভাবনা হাজির হয়, তখন নষ্ট হয় ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনের ভারসাম্য।
এই অস্বাস্থ্যকর জীবনধারাও একসময় তাঁর কাজের স্পৃহা নষ্ট করে দেয়। এমন হলে সব সময় একটা অশান্তিতে ভুগতে পারেন ওই কর্মী। ফলে সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। নিয়মমাফিক কাজের চর্চাও হতে পারে ব্যাহত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি গবেষণা বলছে, যাঁরা সপ্তাহে ৫৫ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কাজ করেন, তাঁদের স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে যায়। সপ্তাহে যাঁরা ৩৫ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করেন, তাঁদের চেয়ে ৫৫ ঘণ্টা কাজ করাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ৩৫ শতাংশ, হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে ১৭ শতাংশ বেশি।
মানবদেহ কোনো যন্ত্র নয় যে তা একটানা একই গতিতে কাজ করে চলবে। কায়িক শ্রম হোক কিংবা ডেস্কে বসে মস্তিষ্কের কাজ হোক, বিরতি তো নিতেই হবে।
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ বলছে, একটানা ৯০ মিনিট বা তার বেশি সময় ধরে কাজ করলে কাজের গুণগত মান কমে যায়। আর কাজে ভুলভ্রান্তির হার বাড়লে কর্মী একধরনের অপরাধবোধেও ভোগেন। বাড়তি চাপ নিয়ে নতুন কাজে হাত দেন তিনি। তাতে ভুলের ঝুঁকি আরও বাড়ে।
নিয়োগকর্তা ভাবতে পারেন, কর্মীর কর্মঘণ্টা যত বাড়ে কিংবা কাজের পরিধি যত বাড়ে, ততই বুঝি প্রতিষ্ঠানের লাভ। আদতে হিসাবটা এত সহজ নয়।
ক্লান্ত, অবসন্ন কর্মীর কারণে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। তাই প্রতিষ্ঠানের লাভের হিসাবেও হয় গন্ডগোল। আমেরিকান জার্নাল অব প্রিভেনটিভ মেডিসিন থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মীদের অবসন্নতার কারণে কোম্পানিগুলোকে প্রতিবছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার গচ্চা দিতে হচ্ছে।
কর্মীপ্রতি লোকসানের হিসাবটাও কম নয়। প্রায় ৪ হাজার থেকে ২১ হাজার মার্কিন ডলার!
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তীব্র কাজের চাপে থাকা কর্মীদের প্রতি এক হাজার জনের জন্য বছরে বাড়তি ৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান হচ্ছে।
তাঁদের গবেষণায় অংশ নেওয়া ১২ শতাংশ কর্মী স্বীকার করেছেন, তাঁরা কাজে ভুল করছেন, সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারছেন না এবং অফিসের নিয়মনীতির বাইরেও যাচ্ছেন। অতিরিক্ত চাপে থাকা কর্মীদের মধ্যে এই হার ১১ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। আরও দেখা গেছে, অতিরিক্ত চাপে থাকা কর্মীদের মধ্যে অসুস্থতাজনিত ছুটি নেওয়ার হার ৮ গুণ।
এমনকি অফিসে থেকেও তাঁরা কাজের কাজ করতে পারছেন না, এমনটা ঘটার হার অন্যদের তুলনায় ৪ গুণ। সব মিলিয়ে লোকসানই হচ্ছে অফিসের। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ তাই ‘স্ট্রেস রিস্ক থার্মোমিটার’ নামের এক নতুন মাপকাঠি সামনে এনেছে, যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজের চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো আরও নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে পারে।
কাজের চাপ এমন হওয়া উচিত, যা কর্মীর কার্যক্ষমতার সীমার মধ্যেই থাকে। কাজের পরিবেশ হতে হবে সহযোগিতাপূর্ণ। অফিসের পরও যেন কাজের ভাবনাতেই ডুবে থাকতে না হয় কাউকে।
কাজ সারার পর কর্মীর হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকতে হবে নিজের ও সম্পর্কগুলোর যত্ন নেওয়ার। সুস্থ এবং সুখী কর্মীই একটি অফিসের সাফল্যের পূর্বশর্ত।
সূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, নিউজ–মেডিকেল ডটনেট, হেলথলাইন