দৈনন্দিন খাবারে সিসার ঝুঁকি থেকে কীভাবে মুক্ত হবেন

দারুচিনি, আপেল এমনকি প্রোটিন পাউডারের মতো জনপ্রিয় পণ্যগুলোয়ও সিসা পাওয়া যাচ্ছে
ছবি: গ্রাফিকস

সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলো আমাদের রোজকার খাদ্যে সিসার উপস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। প্রোটিন পাউডার, দারুচিনি, আপেল এমনকি ডার্ক চকলেটের মতো জনপ্রিয় পণ্যগুলোয়ও সিসা পাওয়া যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আমাদের খাবার কি তবে এক ‘অদৃশ্য ঘাতক’-এর কবলে?

লেড বা সিসা একটি মৌলিক উপাদান, যা মাটি ও পরিবেশে সব জায়গায় বিদ্যমান। ফলে গাছপালা এবং প্রাণিজ খাদ্যে সামান্য পরিমাণে সিসা থাকা স্বাভাবিক। তবে এই সামান্য উপস্থিতি থেকে সৃষ্ট ঝুঁকি এবং জনমনে তৈরি হওয়া আতঙ্কের মধ্যে একটি বড় ফারাক রয়েছে, যাকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘ঝুঁকি উপলব্ধির ব্যবধান’।

ঝুঁকির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে শিশুরা

সিসার কারণে শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে

সিসার কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্পষ্ট জানিয়েছে, শিশুদের জন্য সিসার সংস্পর্শে আসার কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। এমনকি সামান্য মাত্রাও তাদের স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করে, যা বুদ্ধিমত্তার বিকাশে বাধা দেয়। বাংলাদেশেও কোটি কোটি শিশু সিসা দূষণের শিকার।

২০২২ থেকে ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার শিশুদের রক্তে সিসার গড় ঘনত্ব হলো লিটারপ্রতি ৬৭ মাইক্রোগ্রাম। মার্কিন রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) নিরাপদ মান লিটারপ্রতি ৩৫ মাইক্রোগ্রাম, মানে স্বাভাবিকের চেয়ে এই মাত্রা অনেকটা বেশি বলতে গেলে প্রায় দ্বিগুণ। সিসা কোনো মাত্রায় গ্রহণযোগ্য নয়। এই নীরব বিষ শিশুদের আইকিউ কমিয়ে দিচ্ছে, আচরণগত সমস্যা বাড়াচ্ছে।

তবে এ সমস্যায় আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ঝুঁকির মাত্রা পরিমাপের ক্ষেত্রে ‘ডোজ’ বা পরিমাণের গুরুত্ব অপরিসীম। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) সিসা গ্রহণের যে সর্বোচ্চ দৈনিক সীমা (আইআরএল) নির্ধারণ করেছে, তা যথেষ্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই করা হয়েছে।

সিসা দূষণ এড়াতে খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য আনতে হবে

আমাদের করণীয় কী?

১. খাদ্যের বৈচিত্র্য: সিসা দূষণ এড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য আনা। কোনো একটি নির্দিষ্ট খাবার বেশি পরিমাণে বা নিয়মিত না খেয়ে, সব ধরনের খাবার পরিমিত পরিমাণে খান। এটি সিসাসহ যেকোনো পরিবেশগত দূষণকারীর সংস্পর্শ কমিয়ে দেবে।

২. সরকারি নজরদারি: সিসার প্রধান উৎস, যেমন পুরোনো রং, দূষিত পানি ও ব্যাটারি কারখানার বর্জ্য—এগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।

৩. সচেতনতা বৃদ্ধি: সিসাযুক্ত মসলা, খেলনা বা প্রসাধনী ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। শিশুদের মাটি বা পুরোনো পেইন্টযুক্ত দেয়ালে খেলতে নিরুৎসাহিত করুন।

প্রয়োজন দ্রুত ও সম্মিলিত পদক্ষেপ

২০৪০ সালের মধ্যে ‘সিসামুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে, যা বাস্তবায়নে গৃহীত কর্মপরিকল্পনাগুলো হচ্ছে:

১. উৎস অপসারণ: সিসা দূষণের হটস্পট চিহ্নিত করে দ্রুত অপসারণ ও মাটি পরিষ্কার করা।

২. নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রয়োগ: সিসাযুক্ত রং, মসলা ও পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রির ওপর কঠোর নজরদারি এবং আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

৩. জনসচেতনতা: সিসা দূষণ প্রতিরোধের উপায় (যেমন: ঘন ঘন হাত ধোয়া, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ও পুরোনো রং করা দেয়াল থেকে শিশুদের দূরে রাখা) নিয়ে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করা।

সিসা নিয়ে ‘ভূতের ভয়’ নয়, বরং বৈচিত্র্যময় ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাসই হোক সুস্থ থাকার মূলমন্ত্র। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে একটি সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।

সোর্স: ওয়েব এমডি, জার্নাল অব হেলথ অ্যান্ড পলিউশন