আসবাব ছাড়া একটা বাসা বা মানুষের জীবনযাপন কল্পনা করুন তো। প্রায় অসম্ভব। আর ঠিক এ কারণেই মানবসভ্যতার ইতিহাস যত পুরোনো, আসবাবের ইতিহাসও প্রায় ততটাই পুরোনো।
প্রাচীনকালে আসবাব বলতে ছিল তাক আর বিছানা বা বিছানাসদৃশ বস্তু। বসার জন্য ব্যবহৃত হতো পাথর বা কাঠের গুঁড়ি। টেবিল হিসেবেও এগুলো ব্যবহৃত হতো। একেশিয়া ও সিডার কাঠ দিয়ে আসবাব তৈরি করত প্রাচীন মিসরীয়রা। রাজা–বাদশাহ আর ফারাওরা কাঠ ছাড়াও আসবাব তৈরিতে ব্যবহার করতেন হাতির দাঁত, চুনাপাথর আর সোনা। পরবর্তী সময়ে গ্রিকরা জলপাই আর ওকগাছের কাঠ দিয়ে আসবাব বানানো শুরু করে। গ্রিকদের মতো রোমানরাও বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাব বানাত। বিচ, ম্যাপল আর পাইনগাছ দিয়ে আসবাব তৈরির চল শুরু করে তারা। প্রাচীন যুগের শেষ দিকে রোমানরা কাঠের সঙ্গে মার্বেল, হাতির দাঁত আর চুনাপাথর মিলিয়ে আসবাব বানাত।
মধ্যযুগের আসবাবগুলো ছিল সাদামাটা নকশার এবং ‘র’। মধ্যযুগে মূল্যবান আর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রাখার জন্য জনপ্রিয়তা পায় সিন্দুক। এ সময়ে মূলত ওক, আখরোট প্রভৃতি কাঠ দিয়ে আসবাব তৈরি হতো। সিন্দুকের পাশাপাশি ভারী কাঠের পায়াযুক্ত ট্রেসল ডাইনিং টেবিলের চলও তখন থেকেই শুরু। চেয়ার নয়, বসার জন্য বেশি ব্যবহৃত হতো কাঠের লম্বা বেঞ্চ। মধ্যযুগের শেষের দিকে আসে সাধারণ নকশার বাক্স বা কাপবোর্ড খাট।
রেনেসাঁ যুগে আসবাব তৈরিতে যুক্ত হয় বেশ কিছু নতুন উপাদান। ঘরের দেয়ালে আঁকার চলও এই সময় থেকেই। রেনেসাঁ পিরিয়ডেই মেহগনি কাঠ আসবাব তৈরির উপাদান হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। ক্ল্যাসিক্ল্যাল প্যাটার্ন, ফুলেল নকশা থেকে বাইবেল–এর বিভিন্ন বর্ণনার দৃশ্য অন্দরে ঢুকে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোনিয়াল পিরিয়ডে আসবাবের নকশা ছিল একেবারেই ছিমছাম। বিছানা, চেয়ার, টেবিল, বাইবেল রাখার বাক্স, লেখার ছোট টেবিল, ক্যাবিনেট এগুলো ছিল।
আসবাব আর অন্দরসজ্জায় বড় একটা পরিবর্তন আসে ভিক্টোরিয়ান আমলে (১৮৩৭-১৯০১)। দেখা যায় গথিক, রকোকো আর রেনেসাঁ স্টাইলের সম্মিলন। কালো রঙের কাঠ যেমন মেহগনি বা রোজউড দিয়ে আসবাব তৈরির চল বেড়ে যায়। ভারী আসবাব, অত্যধিক কারুকার্য, চড়া রং আর জমাকালো নকশা—এগুলোই ছিল সে সময় আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। নিচের দিকে গোল আর লম্বা ধাঁচের ফুলদানি, লন্ঠন, ঝাড়বাতি, দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের কারুকার্য, ফুলেল নকশা ভিক্টোরিয়ান সময়েরই প্রতিনিধিত্ব করে। এই সময়কে বোঝাতে কোনো একটা আসবাবকে যদি বেছে নিতে হয়, তাহলে সেটা হবে সোফা। বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক সেই সোফা।
বিশ শতক থেকে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে হালকা, টেকসই, ছোট আসবাব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসবাবে যুক্ত হয় নতুন নতুন নানা উপকরণ। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর আগে থেকেই অন্য সবকিছুর মতো আসবাবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে প্রযুক্তি। আসবাবকেও অনুপ্রাণিত করে থ্রিডি মোটিফের ডিজাইন। আধুনিক সময়ে হালকা, ছিমছাম নকশার একাধিক কাজে ব্যবহার উপযোগী টেকসই ও পরিবেশবান্ধব আসবাবের চল বেশি। অন্দরসজ্জায় মিনিমালিজম ধারা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আসবাবের ক্ষেত্রেও ‘যেটুকু না হলেই হয়’ কথাটি সমানভাবে প্রযোজ্য।
বনেদি, রুচিশীল, উচ্চমধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের অন্দরে অ্যান্টিকের কদর সব সময়ই ছিল। তবে বিশ্বায়নের কল্যাণে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে সেজে উঠছে আধুনিক অন্দর। সেই সুযোগে বেশ কিছু সাবেকি ধাঁচের আসবাব নাগরিক অন্দরে ঢুকে পড়ছে। কী সেগুলো? অ্যাস্থেটিক ইন্টেরিয়রস–এর প্রধান পরামর্শক ও ডিজাইনার সাবিহা কুমু দিলেন বেশ কিছু অ্যান্টিক আসবাবের খোঁজ, যেগুলো কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক নাগরিকের অন্দরে ঢুকে পড়েছে।
ভিক্টোরিয়ান সোফা
মিনিমালিজমের জয়জয়কারের মধ্যেই কিছুটা আধুনিক হয়ে সগৌরবে ফিরে এসেছে ভিক্টোরিয়ান সোফা। ভিক্টোরিয়ান সোফা ছাড়া উচ্চবিত্তদের ড্রয়িংরুম যেন অসম্পূর্ণ। সোফার কভার হিসেবে আছে মখমল আর অন্যান্য ফাইবারের সঙ্গে মিশ্রিত পলিয়েস্টার বা স্প্যানডেক্স কাপড়। সোফার কভারের রং হিসেবে সবচেয়ে বেশি চলছে অফ হোয়াইট, ক্রিমসন রেড, মেরুন, রয়্যাল ব্লু, পাইন গ্রিন বা এই জাতীয় শেড, ভিক্টোরিয়ান সময়েই যেগুলোর চল ছিল বেশি।
কারুকার্যখচিত পালঙ্ক
সাধারণ মানুষও এখন পালঙ্ক নিয়ে আগের চেয়ে বেশ আগ্রহী। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে পালঙ্ক। সাধারণ খাট থেকে এগুলোর উচ্চতা একটু বেশি। চারপাশে চারটা লম্বা স্ট্যান্ড। সাধারণত মশারি খাটানোর কাজে এগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে মশারির বদলে চারধারের স্ট্যান্ড ঘিরে সাদা পর্দার ব্যবহারও এখন চোখে পড়ছে।
ঝাড়বাতি
আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অনেকেই ড্রয়িংরুমে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন একটি ঝাড়বাতি। এগুলোর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে মফস্সল শহরেও ঢুঁ দিলে ঝাড়বাতির একাধিক দোকান চোখে পড়বে। কয়েক হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকার ঝাড়বাতি পাওয়া যায়। জনপ্রিয়তা ঝাড়বাতিকে মধ্যবিত্তের হাতের নাগালেও নিয়ে এসেছে।
জলচৌকি
আধুনিক অন্দরে অনেকটা মোড়ার কাজ করছে বসার এই সাবেকি আসবাব। রান্নাঘরে, বারান্দায়, এমনকি ড্রয়িংরুমেও ঢুকে পড়েছে নকশাদার জলচৌকি। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্যও টেবিলের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব জলচৌকি।
কাঠের সিন্দুক
গয়নার বাক্স হিসেবে ছোট ছোট কাঠের সিন্দুকের চল সবচেয়ে বেশি। তবে অনেকে ‘স্টোরেজ’ হিসেবেও ব্যবহার করেন প্রমাণ আকৃতির কাঠের সিন্দুক। কাঠের সিন্দুকের পাশাপাশি নানা ফরম্যাটের লোহার লকারও চোখে পড়ছে আজকাল।
ট্রাংক
সাধারণত জামাকাপড়, বইখাতা বা অন্যান্য নানা কিছু রাখার জন্য আগে বাড়িতে থাকত একাধিক ট্রাংক। চাকাযুক্ত ট্রাভেল ব্যাগ জনপ্রিয়তা পাওয়ার আগে অনেক সময় ট্রাংকে করেই জামাকাপড় ও বিভিন্ন কিছু বহন করা হতো। স্টিলের ট্রাংকের আগে ধাতব ট্রাংক ব্যবহৃত হতো। এখন রিকশা পেইন্ট করা ট্রাংক ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখার অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বাজেটের ভেতরেই মিলবে এই ধরনের ট্রাংক।
দেয়াল ঝোলানো আয়না
আগে বড় একটা আয়না দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার চল ছিল। মিনিমালিস্টিক লাইফস্টাইলে আবার সেটা ফিরেছে। তবে এখনকার দেয়ালে ঝোলানো আয়নাগুলোতে সে রকম কারুকার্য থাকে না। আকারেও এগুলো ছোট। অনেক সময় হেলান দিয়ে রাখা হয় লম্বা বড় আয়না।
ইজিচেয়ার
স্বমহিমায় ফিরেছে ইজিচেয়ার। আগে বাড়ির কর্তার জন্য একটা কাঠের খানদানি ইজিচেয়ার বরাদ্দ থাকত। তিনি সেখানে বিশ্রাম করতেন বা পড়াশোনা করতেন। এখন বাড়ির সবাই ইজিচেয়ার ব্যবহার করে। আর এখনকার ইজিচেয়ার স্টিল, কাঠসহ আরও নানা উপাদানে তৈরি।
দোলনা
অনেকের বাড়িতে, বিশেষ করে বারান্দা বা ছাদে দোলনা দেখা যাচ্ছে। আগে কাঠের দোলনার চল ছিল বেশি। এখন লোহা আর স্টিলের দোলনা চলছে। শিকলের অংশটি আগে ছিল লোহার, এখন সাধারণত পিতলের হয়ে থাকে।
অনেকেই আবার প্রাচীনকালের আসবাবের মতো দেয়ালে কাঠের তাক লাগিয়ে নেন। সেখানে শোভা পায় নানা ডেকোরেশনের পিস, গাছ বা বই। বিছানার পাশে নকশা করা কাঠের সাইডটেবিলের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।
ছোট ও বড় পর্দার চেনা মুখ শবনম ফারিয়া সাবেকি আসবাব ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ডাইনিং টেবিলে বসার জন্য ফারিয়ার বাড়িতে রয়েছে ৫০ বছরের বেশি পুরোনো দুটি বেঞ্চ। পুরোনো আমলের কাঠের একটা সিন্দুকের ওপর লম্বা একটা আয়না দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রেখেছেন। সেটাই নাকি তাঁর ড্রেসিংটেবিল।
আসবাবে আটকে নেই সাবেকিয়ানা
সাবিহা কুমু আরও জানান, কেবল আসবাবেই নয়, বরং ব্যবহার্য নানা কিছু আর অন্দরসজ্জায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে নানা অ্যান্টিক জিনিসপত্র। বিশেষ করে বাসনকোসনে নতুন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সিরামিকের নকশা করা প্লেট, বাটি, ডিনার সেট।
কাঁসা–পিতলের ব্যবহারও বাড়ছে। লম্বা লম্বা ভিক্টোরিয়ান ফুলদানির কদর বেড়েছে। আসবাবের নকশাকার ও অন্দরসজ্জাবিদ সাবিহা কুমু বলেন, ‘সোফার কুশনেও থ্রিডি প্রিন্টের পাশাপাশি চলছে হাতে নকশা করা বা কুরুশ কাটা কুশন।
ডাইনিং টেবিলের রানারেও তাই। নকশিকাঁথা, মসলিন, জামদানি, গারদ শাড়ির ব্যবহারও বাড়ছে। ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে অনেকেই রাখছেন লন্ঠন। ফ্লোরেও বাড়ছে মার্বেল, জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার।’ সাবিহার মতে, এতে অন্দর হয়েছে আরও বৈচিত্র্যময় ও নান্দনিক।