সাংবাদিক ও গবেষক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
সাংবাদিক ও গবেষক মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

জেলায় জেলায় ঘুরে গ্রাফিতির ১০ হাজার ছবি তুলেছেন মাহমুদুজ্জামান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতির ছবি তুলতে থাকেন মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে যাচ্ছেন জেলায় জেলায়। নিজের তোলা হাজার হাজার ছবি থেকে প্রদর্শনীর আয়োজনও করেছেন। মাহমুদুজ্জামানের কাছে গ্রাফিতির ছবি তোলার অভিজ্ঞতা শুনেছেন কাজী আলিম-উজ-জামান

রংপুরের একটি স্কুলের দেয়ালে গ্রাফিতি দেখে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান। গিলোটিনে একটি পেনসিল; পাশে লেখা ‘মাথা কাটিয়া দিলে লিখিতে পারি আবার’। আবার ঢাকার মিরপুরে বাঙলা কলেজের সামনে একটি গ্রাফিতি দেখে ভালো লাগল সেটির ভাষা। লেখাটি ক্যামেরায় বন্দী করলেন মাহমুদুজ্জামান, ‘মানুষ পানিতে ভিজলে কাপড় বদলায়, ঘামে ভিজলে ভাগ্য বদলায় আর রক্তে ভিজলে ইতিহাস বদলায়’।

গ্রাফিতি আর দেয়াললিখনের ছবি তুলতে তুলতে এমন কত যে শব্দ, বাক্য ও আঁকা দেখে আপ্লুত আর বুঁদ হয়ে ভেবেছেন এসবের গভীরতা। মাহমুদুজ্জামানের কথায়, ‘এত দিন আমরা জানতাম দেয়ালের কান আছে; কিন্তু জেন–জি প্রমাণ করেছে দেয়ালের মুখ আছে।’

মাহমুদুজ্জামান পড়াশোনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ইতিহাস গবেষণাবিষয়ক যুক্তরাজ্যের সংগঠন রয়্যাল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির অ্যাসোসিয়েট ফেলো তিনি। বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস শিশু-কিশোর ও সাধারণের সামনে তুলে ধরতে দুই দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন এই সাংবাদিক ও গবেষক।

রংপুরের একটি স্কুলের দেয়ালে গ্রাফিতি

মাহমুদুজ্জামান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই খেয়াল করলেন, শহর-নগরের দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন চলছে। তাঁর মনে হলো গ্রাফিতিগুলো বছরের পর বছর দেয়ালে থাকবে না। বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে পারে, দেয়াল ভাঙা পড়তে পারে, মুছে ফেলাও হতে পারে। তাই ‘দেয়ালের ভাষা’ সংরক্ষণ করতে লেগে পড়লেন তিনি।

শুরুতে ঢাকার গ্রাফিতির ছবি তুলেছেন মাহমুদুজ্জামান। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে ছবি তোলা শুরু করেন তিনি। এ পর্যন্ত ৪২ জেলায় গেছেন, তুলেছেন ১০ হাজারের বেশি ছবি। কাজটা চলমান।

জেলায় জেলায় কত অভিজ্ঞতা

ঢাকার বনশ্রীতে একটি দোকানের দেয়ালে লেখা ‘আজ ৩২ জুলাই’। গত বছরের আগস্টের শুরুতে সেটি তুলতে গিয়ে কয়েকজন যুবক মাহমুদুজ্জামানকে ঘিরে ধরেছিলেন। দ্রুত ফোনটি পকেটে পুরে তিনি পরিস্থিতি সামাল দেন। মিরপুর ১০ নম্বরে মেট্রোরেলের পিলারে আঁকা একটি গ্রাফিতি দেখে তিনি চমকে ওঠেন ‘[বাংলাদেশ] ধর্ম যার যার, দেশ সবার।’ ‘বাংলাদেশ’–এর জায়গায় তাঁরা বাংলাদেশের ম্যাপ ব্যবহার করেছেন।

পথ পার হতে গিয়ে একটি রোড ডিভাইডারে কাঁচা হাতে আঁকা একটি গ্রাফিতি দেখে থমকে যান তিনি। একটি ছোট মেয়ে তার বাবাকে বলছে, ‘বাবা ওরা কি আমাকেও গুলি করবে?’ বাবা উত্তর দিচ্ছেন, ‘না মামণি, আমরা স্বাধীন।’ পুরো লেখাটি কালো কালিতে, শুধু ‘স্বাধীন’ শব্দটি লাল সবুজ!

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতির ছবি তুলতে থাকেন মাহমুদুজ্জামান

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন গত ২৪ আগস্ট। সারা দিন ক্যাম্পাসের ভেতরে আঁকা গ্রাফিতি, রাস্তা ও গাছের গায়ে লেখার ছবি তুললেন। তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় গ্রাফিতিটি আঁকা হচ্ছিল। তিনজন মিলে বিশাল একটি নৌকা আঁকছিলেন। নৌকায় পানি উঠছে। পানি সেচতে ব্যস্ত সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। পাশে শেখ হাসিনা বিমানের পিঠে চড়ে পালাচ্ছেন। শিল্পীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী; কেউই চারুকলার নন।

রংপুরের কলেজশিক্ষক মনিরুজ্জামান তাঁর দুই সন্তানকে ঘরে আটকে রাখতে পারছিলেন না। তারা গ্রাফিতি আঁকবেই। বাধ্য হয়ে তিনিও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন।

অঞ্চলভেদে গ্রাফিতিতেও কিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছে। ঢাকায় যে গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে ‘ঘুষ চাইলে ঘুষি’, চট্টগ্রামে সেটি হয়েছে ‘ঘুষ চাইলে মাইজ্যোম’। ঢাকায় যেটা ‘আইজ অন ডাকাত’, চট্টগ্রামে সেটি ‘ডাকাইত হন্ডে?’ কোথাও আবার ‘স্বপ্নের শহর নাটোর’ কিংবা ‘রাজশাহী’তে যে ম্যাপ আঁকা হয়েছে, সেই ম্যাপে ওই জেলার আয়তন সবচেয়ে বড় দেখানো হয়েছে।

আবার গোপালগঞ্জে সারা দিন ঘুরেও বেশি গ্রাফিতির ছবি তুলতে পারেননি মাহমুদুজ্জামান। কারণ, সেখানে এই শিল্পকর্মটি কম দেখা গেছে। দু-একটা থাকলেও ছবি তুলতে গেলে অপরিচিত লোকেরা এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ‘কেন তুলছেন’, ‘এসব কী দরকার’, এমন নানা প্রশ্নে তাঁকে জর্জরিত করেছেন।

এ পর্যন্ত ৪২ জেলায় গেছেন, তুলেছেন ১০ হাজারের বেশি ছবি

‘এখানে যে ময়লা ফেলবে, সে হাউন আঙ্কেল’, ‘একজন ভিভিআইপির জন্য সারা দেশ থেমে থাকতে পারে না’, ‘সংস্কার শুধু দেশের নয়, মনের’, ‘চেটে নয়, খেটে বড় হও’—এসব গ্রাফিতির পাশাপাশি শহর পরিচ্ছন্ন রাখা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিবিষয়ক নানা গ্রাফিতি তাঁর চোখে পড়েছে। এমনকি স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্কে ‘তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ না ঘটানো’র গ্রাফিতিও আঁকা হয়েছে। কোথাও তাঁরা নিজেদের তুলনা করেছেন স্পাইডার–ম্যান, সুপারম্যান বা অ্যাভেঞ্জারস হিরোদের সঙ্গে।

মাহমুদুজ্জামান বলছিলেন, গ্রাফিতিতে আসেনি এমন কোনো বিষয় নেই। এই প্রজন্মের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো অতি সিরিয়াস বিষয়ও তারা রসিকতা করে বা হালকা চালে প্রকাশ করতে পারে।

নানা জায়গায় প্রদর্শনী

মাহমুদুজ্জামান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করেন না। তাই গ্রাফিতি নিয়ে তাঁর ভাবনা সরাসরি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাবেক সভ্য সংঘের আয়োজন, পাঠচক্র ভাব বৈঠকীর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল সায়েন্স ভবনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), জাতীয় প্রেসক্লাবে নীতি গবেষণা কেন্দ্রের প্রোগ্রামসহ নানা আয়োজনে তাঁর গ্রাফিতির ছবি প্রদর্শিত হয়েছে।

নিজের তোলা হাজার হাজার ছবি থেকে প্রদর্শনীর আয়োজনও করেছেন মাহমুদুজ্জামান

জুলাই আন্দোলনের এক বছর পর ঢাকার দেয়ালের অনেক গ্রাফিতিই নষ্ট হয়ে গেছে বা চাপা পড়েছে। ঢাকার বাইরেও তাই। এই জায়গা থেকে মাহমুদুজ্জামানের কাজটি আরও বড় হয়ে ওঠে। মিসরে আরব বসন্তের সময় আঁকা সব গ্রাফিতি সংরক্ষণ করতে না পারলেও মোহাম্মদ মাহমুদ সড়কের গ্রাফিতিগুলো রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটু ঝাপসা হয়ে গেলে আবার নতুন করে রং করা হয়। বাংলাদেশেও অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গ্রাফিতিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, এমন মনে করেন মাহমুদুজ্জামান।

নিজে ছবি তোলার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে গ্রাফিতির ছবি সংগ্রহ করছেন মাহমুদুজ্জামান। এসব নিয়ে একটি আর্কাইভ গড়ে তোলার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর, যাতে ভবিষ্যতের গবেষকেরা এখান থেকে প্রাইমারি সোর্স খুঁজে পেতে পারেন। একটি প্রজন্ম তাদের নিজস্ব সব ভাবনা এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশা সবই লিখে রেখেছে। আমাদের শুধু বুঝে নিতে হবে, এ বার্তাটাই পৌঁছে দিতে চান তিনি।