অধুনার নিয়মিত বিভাগ ‘পাঠকের প্রশ্ন’। এই বিভাগের বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ব্যরিস্টার মিতি সানজানা। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পাঠকদের আইনি প্রশ্নের পরামর্শ দিচ্ছেন। পত্রিকায় কলাম লিখে নানা অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে তাঁর। সেই অভিজ্ঞতার কিছু অংশ পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে একজন অচেনা নারী আমাকে ফোন করেন। তিনি ক্রমাগত কাঁদছিলেন। ওনার কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। জড়িয়ে যাচ্ছিল। আমি তাঁকে স্বাভাবিক হয়ে পরে আবার ফোন করতে বলি।
এরপর ওনার সেই নম্বর থেকে একটি সিসিটিভি ফুটেজ আসে। সেখানে দেখা যায়, এক লোক তাঁর স্ত্রীর বুকে পাড়া দিচ্ছেন, চুল ধরে টেনেহিঁচড়ে তাঁকে বিছানা থেকে নামাচ্ছেন। গলা টিপে ধরছেন।
নারীটি বারবার নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু পেরে উঠছেন না। পাশে দুটি শিশুসন্তান (পরে জেনেছি তাদের বয়স ৬ ও ৩ বছর) অত্যন্ত ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত। দুজনেই বাবাকে অনুরোধ করছে, তিনি যেন তাদের মাকে মেরে না ফেলেন।
ভিডিওটি দেখে আমি দ্রুত ওই নম্বরে কল করি। বারবার ফোন দিয়েও কাজ হয়নি, নম্বরটা ততক্ষণে বন্ধ পাই। দুই দিন পর আবার তিনি আমাকে ফোন করেন। জানতে পারি, তিনি তাঁর স্বামীর দ্বারা ভয়াবহ পারিবারিক সহিংসতার শিকার।
তাঁকে ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি বাসায় আটকে রাখা হয়েছে। জরুরি দরকারে বাইরে গেলে সঙ্গে কয়েকজন দেহরক্ষী থাকে। তাঁর বাবার বাড়ির লোকজন দেশের বাইরে থাকেন। ঢাকায় যাঁরা আছেন তাঁদের সঙ্গে স্বামী কোনো যোগাযোগ করতে দেন না। তিনি নিজের ও সন্তানদের জীবন নিয়ে শঙ্কিত।
আরও জানতে পারি, ওই নারীর স্বামী তাঁর ও সন্তানদের পাসপোর্ট লুকিয়ে রেখেছেন। কারণ, তাঁরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ওই নারীর হাতে কোনো টাকাপয়সা দেওয়া হয় না। তিনি বেশ কিছু ছবি আমাকে পাঠান, যেখানে দেখা যায় তাঁর শরীর ও মুখে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন।
বাইরের লোকজন এসব দেখে ফেলবে বলে তিনি বোরকা পরে বাইরে যান। প্রথম আলোর অধুনায় উনি আমার কলাম পড়ে আমাকে খুঁজে বের করেন এবং জীবন–শঙ্কায় আমার সাহায্য চান।
আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দূতাবাসে যোগাযোগের পরামর্শ দিই। দূতাবাসে যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হবে, সব কাগজপত্র রেডি করে দিই। সবকিছু নিয়ে সুযোগ বুঝে তিনি তৃতীয় পক্ষের সাহায্যে দূতাবাসে গিয়ে সবকিছু জানান।
নিজের ব্যবহার করা গয়না বিক্রি করে তিনি কিছু টাকাও জোগাড় করেন। এর মধ্যে আমাদের জমা দেওয়া কাগজ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দূতাবাস জরুরি পাসপোর্ট ইস্যু করে। ওনার টিকিটের ব্যবস্থা হয়।
তিনি এক কাপড়ে তাঁর দুই শিশুসন্তান নিয়ে অনেকটা সিনেমার গল্পের মতো বিমানবন্দরে চলে যান। এদিকে আমিও অপেক্ষায় থাকি কী হয় কী হয়।
ইমিগ্রেশন পার হয়ে প্লেন ছাড়ার মুহূর্তে তিনি আমাকে তাঁর দুই সন্তানের ছবি পাঠান। ছবি দেখে কিছুটা স্বস্তি পাই। কিন্তু তারপরও ওনারা না পৌঁছানো পর্যন্ত দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। ফ্লাইট ছিল গভীর রাতে। উনি প্লেনে না ওঠা পর্যন্ত আমি জেগে বসে রইলাম।
প্লেনের দরজা বন্ধ হওয়ার পর ওই নারী আমাকে ফোন করলেন। মনে হলো অচেনা এক পাঠকের সঙ্গে কী এক ফিল্মি জার্নির শেষ দিকে এসে পড়েছি। নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা নিরাপদে আমেরিকায় পৌঁছালেন। আমিও যেন এক রুদ্ধশ্বাস গল্পের সফল সমাপ্তি দেখতে পেলাম।
অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেলেও ওই নারী এখন অনেক ভালো আছেন। আমাকে প্রায়ই নিজের ও সন্তানদের নানা রকম হাসিখুশি ছবি পাঠান। ফোন করে আমার খোঁজ নেন। মন ভরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি আমার সন্তানদের জন্যও অনেক দোয়া করেন। প্রথম প্রথম যখন ওনার সঙ্গে কথা হতো, তিনি কাঁদতেন।
গুছিয়ে কিছু বলতে পারতেন না। এখন তিনি অনেক ভালো আছেন। সন্তানেরা স্কুলে যাচ্ছে। বিদেশে গিয়ে ওই নারী নিজেও দীর্ঘ এক যুগ পর কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন।
পত্রিকায় আমার আইনি পরামর্শের কলাম পড়ে তিনি আমাকে খুঁজে বের করেছিলেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে আইনি সহায়তা দিয়েছি। অথচ আমরা কেউ কাউকে সামনাসামনি দেখিনি। অধুনায় আইনি পরামর্শ দিচ্ছি প্রায় এক যুগ।
দেশ–বিদেশের নানা জায়গা থেকে লোকে সাহায্য চেয়ে মেইল করেন, চিঠি পাঠান। অনেকে পত্রিকা অফিস থেকে ফোন নম্বর নিয়ে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এসব সমস্যার সমাধান দিতে গিয়ে রোজ নানা রকম গল্প জমা হচ্ছে। অচেনা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের এই সাঁকো পার হতে আমার খুবই ভালো লাগে। তৃপ্ত হই।