মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: ফারুক হোসেন, সপ্তম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), চুয়াডাঙ্গা একাডেমি, চুয়াডাঙ্গা
বর্ণনাকারী: মো. কাশেম হক, পীতম্বরপুর, চুয়াডাঙ্গা
সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতি–দাদা
তখন আমি কাজের খোঁজ করছি। একদিন আমাদের গ্রামে হঠাৎ একজনের সঙ্গে দেখা। তাঁকে সালাম দিলাম।
আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নাকি কাজের খোঁজ করছ?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কে ভাই?’
তিনি বললেন, ‘আমার বাড়ি ভালাইপুর মোড়। সেখানে একটা কারখানা তৈরি হচ্ছে, কাজ পাবেন।’
বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি যাব।’
দুই দিন পর ভালাইপুর গেলাম। গিয়ে দেখি, তাঁরা এসেছেন। সবাই কাজকর্ম করছেন। একজনকে বললাম, ‘ভাই, এখানে কোনো লোকজন নেবে না?’
বললেন, ‘সব লোক নেওয়া হয়ে গেছে। এখন দেখতে হবে আমাদের মিয়ার কাছে।’
গেলাম সেই ‘মিয়া’র কাছে। তাঁকে জানালাম, আমি কাজ খুঁজছি। তিনি আমাকে কাজে নিলেন।
তারপর কাজ করার জন্য প্রতিদিন যেতাম সেখানে। কারখানাটিতে ঢেউটিন তৈরি হতো। টিনের নাম ‘রাণী মার্কা টিন’। সে সময়ই শুরু হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
পাকিস্তানিরা এল আমাদের গ্রামে। গ্রামের কাছাকাছি তারা ঘাঁটি গাড়ল। তারপর আমরা কয়েকজন একটা উদ্যোগ নিলাম। আমাদের বাড়ির সামনে আমগাছ। আর আমগাছের নিচে বসে ছিলেন আমাদের গ্রামের কয়েকজন মুরব্বি।
তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি আসার শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে লাঠি নিয়ে আমগাছে উঠলেন। পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি আমগাছের নিচ দিয়ে যেতেই তাঁরা গাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর তাঁদের দেখামাত্রই গুলি করে মেরে ফেলল পাকিস্তানি সেনারা!
পরদিন সকালে আবার কাজে গেলাম। কাজ থেকে ফিরে এসে দেখি, পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়ির পেছনের বাড়িতে এসেছে। সেই বাড়িটা ছিল আমার ভাইয়ের। দেখি, ঘর থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দাউ দাউ করে ঘর জ্বলছে। সবাই পানি ঢালছে।
ভাইকে বলি, ‘ভাই, কাঁদিস না।’
এর মধ্যে এক লোককে পাকিস্তানি সেনারা ডাকল। ওই লোক পাকিস্তানি সেনাদের কথা বুঝতে পারে না। তারপরও সে এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা তাকে নিয়ে চলে গেল। সে আর কোনো দিন ফিরে এল না।
পরদিন সকালে কাজে গিয়ে দেখি, রাস্তা থেকে একটু দূরে মাটি লাল দেখাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখি, মাটি রক্তে লাল। ভয়ে–আতঙ্কে কারখানায় ফিরে আসতে আসতে চোখে পড়ল একটা গভীর গর্ত। গর্তের ভেতর ছোট–বড় মানুষ সব কীভাবে যেন পড়ে আছে!
কাঁদতে কাঁদতে ভাবছিলাম, এই মানুষেরা নিশ্চয়ই জীবিত। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা সবাইকে মেরে ফেলল। সোজা মিয়ার বাড়ি গেলাম। দরজা খোলা নেই। সবাইকে ডাকলাম আমি। তখন একজন আমাকে জানালা দিয়ে ডাক দিলেন।
বললাম, ‘ভাই, এত বেলা হয়ে গেল, এখনো বাড়ির দরজা খোলেন নাই কেন?’
লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘মিলিটারিরা আমাদের আটকে রেখে গেছে। আজকে দুপুরে আমাদের মেরে ফেলবে।’
আমি আর কোনো কথাই বলিনি। সত্যিই শুনতে পাই দুপুরে গুলির শব্দ।