শ্রদ্ধা, মমতা, সাহস আর আমার শিক্ষকদের গল্প

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এহসান হক। একদিকে বিজ্ঞানী হিসেবে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পুরস্কার, অন্যদিকে দৌড়, সাঁতার ও সাইক্লিং করে হয়েছেন আয়রনম্যান। গবেষণায় বুঁদ হয়ে থাকেন, আবার লেখালেখিতেও ঝোঁক আছে। পৃথিবীকে ভিন্ন ভিন্ন চোখে দেখার এই ‘প্রশিক্ষণের’ পেছনে তাঁর শিক্ষকদের ভূমিকা কতখানি, আজ শিক্ষক দিবসে পড়ুন তাঁর লেখায়।

নিনা ম্যাডামের সঙ্গে লেখক, তখন তিনি নার্সারিতে পড়েন
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

অধ্যাপক হিসেবে ক্লাসের শুরুতেই আমি এক সরল স্বীকারোক্তি করি, ‘নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, ক্লাসে যা শেখাব, তার ৫ শতাংশও তোমরা কেউ ভবিষ্যতে মনে রাখতে পারবে না। শুধু তা–ই নয়, আমি তোমাদের যা শেখাব, তার সবই বইয়ের পাতা, পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড কিংবা ইউটিউবের ভিডিওতে পাওয়া যাবে। তাহলে প্রশ্ন—তোমরা আমার ক্লাসে কেন এসেছ?’

উত্তর হলো আলোকিত মানুষ হওয়ার জন্য। যেমনটি আমাকে আলোকিত করেছেন আমার ছেলেবেলার প্রাণপ্রিয় শিক্ষকেরা। তাঁদের কথাই আজ শিক্ষক দিবসে কিছু স্মৃতিচারণায় ভাগ করে নিচ্ছি।

শৃঙ্খলার শিক্ষা: নজরুল স্যার

ছোটবেলায় আমি ছিলাম ভয়ংকর দুষ্টু। একের পর এক গৃহশিক্ষক আমার কাণ্ডকারখানায় চাকরি ছেড়ে চলে যেতেন। তখন এলেন নজরুল স্যার—ঝোলানো গোঁফ, শক্তপোক্ত শরীর, চোখেমুখে শৃঙ্খলার ছাপ। প্রথম দিনেই তাঁর বজ্রাঘাতের মতো থাপ্পড়ে বুঝলাম, এবার আর ফাঁকি দেওয়া চলবে না।

তবে স্যারের শাসনের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত মমতা। প্রতিদিন ধৈর্য ধরে আমাকে পড়াতেন। একদিন হঠাৎ টিভির খেলার সংবাদে দেখি, আকাশে উড়ে উড়ে জিমন্যাস্টিক করছেন স্যার! পরে জানতে পারি, তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড়, এমনকি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত। অথচ এত বড় কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও কখনো অহংকার করেননি। তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যান ছিল ছাত্রকে মানুষ করা। স্যারের সেই নম্রতা আর শৃঙ্খলার শিক্ষা আজও আমার জীবনযাত্রার দিশা।

স্বকীয়তার শিক্ষা: কেয়া আপা

পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা পরীক্ষায় ‘আমার শৈশবকাল’ রচনা মুখস্থ না লিখে নিজের মতো করে লিখেছিলাম। ভেবেছিলাম, ফেল করব; কিন্তু কেয়া আপা আমার সাহসকে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বোচ্চ নম্বর দিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, সবার সামনে আমার লেখা পড়ে শুনিয়েছিলেন। কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘সব সময় নিজের মতো লিখবে।’

সেদিন প্রথম শিখলাম নিজের ভেতরের কণ্ঠস্বরকে মূল্য দেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সেই উৎসাহ আজও আমাকে স্বকীয়তার পথে এগিয়ে যেতে সাহস জোগায়।

সৃজনশীলতার শিক্ষা: চপল মামা

চপল মামা গণিতের ছাত্র হয়েও চার বছর আমাদের সব বিষয় পড়িয়েছিলেন। বিজ্ঞানের সূত্র, ইংরেজি গদ্য, সাহিত্যের সূক্ষ্মতা—সব একসঙ্গে মিলিয়ে–মিশিয়ে তিনি শেখাতেন।

চপল মামার সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে)

একবার পরীক্ষায় বইয়ের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিখেছিলাম। শিক্ষক কম নম্বর দিয়ে আমাকে ক্লাসের সবার সামনে বিদ্রূপ করেছিলেন। মন খারাপ করে আসার পর মামা বলেছিলেন, ‘ডোন্ট লিমিট ইওরসেলফ বাই দেয়ার ইনঅ্যাবিলিটি টু জাজ ইউ’ (কেউ যদি তোমার প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারে, তার দায়ভার তোমার নয়)।

এই বাক্য আজও আমার আত্মায় খোদাই হয়ে আছে। সৃজনশীলতা কখনো অন্যের সীমাবদ্ধতায় থেমে থাকে না—এই শিক্ষা দিয়েছিলেন মামা।

মমতার শিক্ষা: নিনা আপা

আমার জীবনের প্রথম শিক্ষিকা রোকেয়া জামান, ডাক নাম ধরে আমরা ডাকতাম নিনা আপা। উদয়নের নার্সারিতে তাঁর স্নেহে আমি বেড়ে উঠেছিলাম। তিনি ছিলেন মায়ের মতো কোমল, আবার প্রয়োজনে কঠোর। তিনি আলতো থাপ্পড়ে আমাদের দুষ্টুমি থামাতেন, আবার হাসিমুখে গান গেয়ে পড়াতেন।

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে দেশের বাইরে হঠাৎ দেখা হয়েছিল। অচেনা শহরে প্রিয় শিক্ষিকাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আশ্চর্যের বিষয়, বহু বছর পরেও তিনি সেই মুহূর্ত মনে রেখেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, কয়েক বছর আগে যোগাযোগমাধ্যমে আমাকে খুঁজে পেয়ে পুরোনো সব স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। যেন গতকালের ঘটনা। তখন বুঝেছিলাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কেবল স্কুলের দেয়ালে আবদ্ধ নয়; বরং আজীবনের। ২০২১ সালে নিনা আপা ইন্তেকাল করেছেন। আমি সব সময় তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

জীবনের শিক্ষা: জহুরা ম্যাডাম

কিশোর বয়সে আরেক অভিজ্ঞতা হয়েছিল জহুরা ম্যাডামের কাছে। ১৯৯৫ সালে খবর এল তিনি বিয়ে করেছেন। পুরো ক্লাস মিলে তাঁর কাছে খাওয়ার দাবি জানালাম। অবাক হয়ে দেখলাম, তিনি সত্যিই আমাদের বাসায় নিমন্ত্রণ জানালেন।

চা-চক্রে আমরা সবাই কৌতূহলী হয়ে তাঁর স্বামীকে দেখছিলাম। বয়সে ম্যাডামের চেয়ে অনেক বড়, যা আমাদের কাছে বিস্ময়কর লেগেছিল। জহুরা ম্যাডাম চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারতেন; কিন্তু তিনি সাহস নিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, জীবনের বাস্তবতায় অনেক সময় এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অন্যরা বুঝবে না। তারপরও আত্মবিশ্বাস আর সম্মানের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হয়।

সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম, শিক্ষক শুধু পড়াশোনা নয়, জীবনের কঠিন সত্যকেও সাহসের সঙ্গে মেনে নিতে শেখান।

শেষ কথা

এই গল্পগুলো আলাদা মনে হলেও আসলে সেগুলো একই স্রোতের অংশ। নজরুল স্যার আমাকে শিখিয়েছেন শৃঙ্খলা, কেয়া আপা দিয়েছেন আত্মবিশ্বাস, চপল মামা খুলে দিয়েছেন সৃজনশীলতার দুয়ার, নিনা আপা শিখিয়েছেন মমতার পাঠ; আর জহুরা আপা শিখিয়েছেন কঠিন বাস্তবতায়ও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস।

তাঁদের শিক্ষা, তাঁদের আলো আজও আমার ভেতরে জ্বলছে। সেই আলো প্রতিসরিত হয়ে যাচ্ছে আমার শিক্ষার্থীদের মধে৵।

আজ শিক্ষক দিবসে আমি আমার সব শিক্ষকের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা, গভীর কৃতজ্ঞতা ও অসীম ভালোবাসা। তাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠুক আমাদের প্রতিটি প্রজন্ম; আর সেই আলোয় আলোকিত হোক আমাদের সোনার বাংলাদেশ।