অলিম্পিকে স্বর্ণপদকজয়ী এই সাঁতারুকে কেন টানা এক বছর আইসক্রিম খাইয়েছেন মা

স্ট্যানফোর্ডের শিক্ষার্থী ছিলেন কেটি লেডেকি। ১৫ জুন সেই ক্যাম্পাসেই সমাবর্তন বক্তা হয়ে হাজির হয়েছিলেন ১৪টি অলিম্পিক মেডেলজয়ী এই মার্কিন সাঁতারু। পড়ুন তাঁর বক্তব্যের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

১৪টি অলিম্পিক মেডেলজয়ী কেটি লেডেকি
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে আমার এমন একজন বাবা আছেন, যিনি ছোটবেলায় ভোর চারটায় ঘুম থেকে তুলে আমাকে সাঁতারের অনুশীলনে নিয়ে যেতেন।

বাবা জানতেন, আমি সাঁতার ভালোবাসি, একই সঙ্গে অঙ্ক। বাবাই শিখিয়েছিলেন, সাঁতারের প্রতিযোগিতার ফল কখনো কখনো সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দিয়ে নির্ধারিত হয়। ১ সেকেন্ডের ১০০ ভাগের ১ ভাগের কারণেও একটা ফল বদলে যেতে পারে। বাবা আমাকে একটি স্টপওয়াচ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব চালু আর বন্ধ করতে। তারপর দেখতে, কত সময় লেগেছে।

(স্টপওয়াচ হাতে নিয়ে) এই দেখো, আমি এখনই একবার করে দেখাই...শূন্য দশমিক ১৬। কখনোই শূন্য দশমিক ১০–এর আগে থামাতে পারিনি। সেদিন বুঝেছিলাম, ১ সেকেন্ডের ১০০ ভাগের ১ ভাগ আদতে কত ছোট। এক অর্থে, সেই অনুশীলন আমাকে এটাও শিখিয়েছে, সময় কত দ্রুত চলে যায়।

আমি জানি, তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো অ্যাসাইনমেন্টের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছ। তবু মনে হচ্ছে স্ট্যানফোর্ডে সময়টা যেন চোখের পলকেই কেটে গেছে। অনেকের হয়তো এমনটা মনে হচ্ছে না। কিন্তু এখন তোমরা সবাই একসঙ্গে সমাবর্তনে বসে আছ। যদি স্ট্যানফোর্ডে চার বছর পড়াশোনা করো—ধরো বছরে প্রায় ৩০০ দিন করে, তাহলে জীবনের প্রায় ১০ কোটি ৪০ লাখ সেকেন্ড এখানে কাটিয়েছ। ১০ কোটি ৪০ লাখ সেকেন্ড!

আজ এখানে যারা আছ, আমি তোমাদের চেয়ে খুব বেশি হলে সাত বছরের বড়। তোমাদের ‘ফ্রি স্টাইল’ আর ‘ফ্লিপ টার্ন’ সম্পর্কে পরামর্শ দিতে পারি, কিন্তু জীবন সম্পর্কে নয়। এমনকি ৩০ বছর বয়সে পৌঁছাতে কেমন লাগে, সেটা বলার জন্যও ঠিক মানুষটা আমি নই।

তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিতভাবে অভিজ্ঞ, সেটা হলো দূরত্ব। একজন দূরপাল্লার সাঁতারু হিসেবে আমি পানিতে বহু মাইল সাঁতরেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করেছি, সুইমিংপুলের নিচের কালো দাগের দিকে তাকিয়ে থেকেছি, শিখেছি এর মানে কী—যখন কেউ দেখছে না, তখনো এগিয়ে যাও। দূরত্ব কীভাবে পাড়ি দিতে হয়, সেটাই বরং আজ বলি।

অলিম্পিকে প্রথম স্বর্ণপদক জেতার সময় আমার বয়স ছিল ১৫। এখন পেছনে তাকালে নিজের কাছেও অবিশ্বাস্য লাগে। মাত্রই তখন হাইস্কুলের প্রথম বছর শেষ করেছি। পুরো মার্কিন অলিম্পিক দলের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট, আর এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে আমার প্রথম কোনো সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া।

কেউ আমাকে চিনত না। অলিম্পিক হচ্ছিল লন্ডনে। আমার ইভেন্টে তখনকার চ্যাম্পিয়ন ও সবার প্রিয় প্রতিযোগী ছিলেন ব্রিটিশ সাঁতারু বেকি অ্যাডলিংটন। জানতাম, দর্শকেরা চিৎকার করবে ‘বেকি’, ‘বেকি’। ভেতরে-ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম, ওরা যতই ‘বেকি’ বলুক, আমি শুনব ‘লেডেকি’, ‘লেডেকি’।

প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্সেস কেটও সেখানে ছিলেন। চারপাশে এত শব্দ! কিন্তু একমুহূর্তে সাঁতারুদের আশপাশ থেকে সব শব্দ মিলিয়ে যায়, যখন কানে আসে ‘টেক ইয়োর মার্ক’। বাঁশি বাজল। দিলাম ঝাঁপ। সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে গেলাম।

আমার কোচ আগেই বলে দিয়েছিলেন, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের পাশের লেনে সাঁতার কাটার উত্তেজনায় যেন খুব দ্রুত শুরু না করি।

ওসব পরামর্শ কি আর মনে থাকে! শুরু থেকেই লিড নিয়েছিলাম আর সেটা ধরে রেখেছিলাম। মাঝপথে এসে ভাবছিলাম, ‘বাকি সবাই কোথায়?’ মুহূর্তের জন্য মনে হলো হয়তো আমি ভুল করছি। হয়তো বেশি দ্রুত শুরু করে ফেলেছি। তারপর নিজেকে বললাম, যা-ই হোক, থেমো না।

চার সেকেন্ডের বেশি ব্যবধানে আমি জিতেছিলাম।

জয়ের পর কোচ আমার কাছে এলেন। চেহারায় বিস্ময়, ‘তুমি তো আমার কথা শোনোনি।’ তারপর জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কিন্তু যা করেছ, ঠিকই করেছ।’

অনেকেই তোমাকে বলবে ধীরে চলতে, তাড়াহুড়া না করতে। বলবে তুমি এখনো তরুণ। হয়তো এ পরামর্শও ভুল নয়। কিন্তু আমি চাই তুমি ভেবে দেখো, তরুণ আর অচেনা হওয়াটা কখনো কখনো তোমাকে বাড়তি সুবিধাও দিতে পারে।

সেই রাতেই অলিম্পিক ভিলেজে প্রতিযোগিতার রিপ্লে দেখছিলাম। প্রায় পুরো রেসেই এনবিসির ধারাভাষ্যকারেরা যেন আমাকে ধীরে যেতে বাধ্য করতে চাইছিলেন। রেস শুরুর ৩৫ সেকেন্ড পর থেকে আমি এগিয়ে ছিলাম।

তাঁরা বলছিলেন, ‘ওকে এখন গতি কমাতে হবে।’ তার ২০ সেকেন্ড পরও আমি এগিয়ে। তখন তাঁরা বলছেন, ‘ওর গতি খুব বেশি। হচ্ছে না। শান্ত হয়ে ছন্দে ফিরতে হবে।’ দুই মিনিট পরই তাঁরা আমার কৌশল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগলেন, ‘এখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। যদি স্ট্রোক আর গতির ওপর খুব আত্মবিশ্বাস না থাকে, তাহলে বোধ হয় একটু তাড়াহুড়াই হয়ে যাচ্ছে। কারণ, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা ঠিক জানে, কী করতে হবে।’

কিন্তু রেসের তিন-চতুর্থাংশ পার হওয়ার পর ধারাভাষ্যকারদের স্বর বদলে গেল। তাঁরা তখন উল্লাস করছিলেন। আমার পক্ষে কথা বলছিলেন। আমার কৌশলকে সন্দেহ করছিলেন না, গতি কমাতেও বলছিলেন না।

ধরো, সাঁতার কাটার পুরোটা সময় যদি তাঁদের কথা শুনতে পেতাম, আমার কী হতো? ভাবতাম, হয়তো তাঁরাই ঠিক বলছেন। আমার বোধ হয় গতি কমানোই উচিত।

মূল কথা হলো, অনেকেই তোমাকে বলবে ধীরে চলতে, তাড়াহুড়া না করতে। বলবে তুমি এখনো তরুণ। হয়তো এ পরামর্শও ভুল নয়। কিন্তু আমি চাই তুমি ভেবে দেখো, তরুণ আর অচেনা হওয়াটা কখনো কখনো তোমাকে বাড়তি সুবিধাও দিতে পারে।

ধীরে চলার উপদেশ শোনা খুব সহজ, ব্রেক কষে দেওয়ার মতো। কিন্তু আমি জানি, একবার দ্রুত শুরু করলে তুমি যতটা ভেবেছিলে, তার চেয়েও অনেক দূরে যেতে পারবে।

তাই আজ বলি, কোচদের কথা শোনো। পরিবারের কথা শোনো। মেন্টর আর বসদের কথা শোনো, কিন্তু নিজের কথাও শোনো। নেতৃত্ব নিতে ভয় পেয়ো না। অনেক সময় তোমাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, আর আবিষ্কার করতে হবে তুমি আদতে কতটা কী পারো।

আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করা হয়, অলিম্পিকে স্বর্ণ জেতার কোনো গোপন সূত্র কি আছে? আজ আমি রহস্যটা তোমাদের বলতে পারি। বলব? এর সঙ্গে খাবারের একটা সম্পর্ক আছে।

যখন আমি সাঁতারের জগতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন অন্য অভিভাবকেরা প্রায়ই মাকে প্রশ্ন করত, ‘তুমি কেটিকে কী খাওয়াও?’

মা তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বলতেন, ‘আরে ধুর! সস্তায় যখন যা পাওয়া যায়, তা-ই খাওয়াই। যদি স্ট্রবেরি সস্তায় মেলে, তাহলে স্ট্রবেরিই সই।’

যখন আমার বয়স প্রায় ১০ বছর, মা কোথায় যেন পড়েছিলেন, লো-ফ্যাট চকলেট দই সাঁতারুদের জন্য ভালো নাশতা। কিন্তু কোনো কারণে দোকানে লো-ফ্যাট চকলেট দই পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই প্রায় এক বছর মা আমাকে দইয়ের বদলে চকলেট আইসক্রিম খাইয়েছেন। সম্ভবত এই লোভেই প্রতিদিন সকালে এত আগ্রহ নিয়ে অনুশীলনের জন্য উঠে পড়তাম!

মজার ব্যাপার হলো, আইসক্রিমের গল্পটা শুনতে সবাই পছন্দ করে। কিন্তু এ গল্প যেন সবাইকে একটু হতাশই করে। মনে মনে তারা বলে, ‘আহহা কেটি, দুষ্টুমি ছেড়ে সত্যিকার রহস্যটা বলো তো!’ এটা ঠিক, আসল রহস্য আইসক্রিম নয়। সত্যি কথা হলো, আদতে কোনো রহস্য নেই।

হয়তো সবচেয়ে কাছাকাছি উত্তর এটাই, আমি লক্ষ্য স্থির করি, কিন্তু কখনোই জেতার জন্য নয়।

জয় নির্ভর করে তুলনার ওপর। অন্যের সঙ্গে তুলনা। কিন্তু তুমি বারবার জিতলেও শেষমেশ তুলনা তোমার নিজের সঙ্গেই হয়। তোমার আগের, তরুণ আর শক্তিশালী সংস্করণের সঙ্গে। তাই আমার লক্ষ্য সব সময় নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে।

সব সময় সময়নির্ভর। এ কারণেই বলি, তোমাকে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় জিততে হবে না, তুমি শুধু তোমার নিজের দৌড়ে জেতো। নিজের দৌড় জেতা মানে হলো প্রক্রিয়াটাকে ভালোবেসে ফেলা। প্রক্রিয়াকে ভালোবাসো, মঞ্চকে নয়।

(সংক্ষেপিত)