মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী

বাবাকে আর ডাব পাড়তে হলো না

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো

সংগ্রহকারী: খাদিজা আক্তার, সপ্তম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), চামটা বি কে ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঝালকাঠি

বর্ণনাকারী: রোকেয়া বেগম, ঝালকাঠি

সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতনি–নানি

বাবা ঠিক করলেন, আমাকে নিয়ে বাড়ির দিকে যাবেন

গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে পড়েছে। প্রাণের ভয়ে সবাই পালাতে লাগল। আমার দুই ভাই এক বোন। আমার বয়স তখন আট বছর, আমি সবার বড়। আমাদের নিয়ে বাবা কোথায় যাবেন, তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই।

বাবার একটা নৌকা ছিল। একদিন সেই নৌকায় উঠে পড়লাম আমরা। সঙ্গে নিলাম কিছু খাবার। নৌকা আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে এল অনেক দূরে।

যেতে যেতে একটা জায়গায় নৌকা ভিড়ল। একটা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম আমরা। আশ্রয় চাইলেন বাবা। তখন সবাই বিপদের মধ্যে, ওই পরিবার প্রথমে আশ্রয় দিতে রাজি হলো না। বাবা খুব অনুরোধ করলেন। আমাদের দেখিয়ে বললেন, ‘ওদের নিয়ে কোথায় যাব?’

বাড়ির লোকেরা রাজি হলেন আমাদের আশ্রয় দিতে। কিছুদিন সেখানেই থাকলাম। চার-পাঁচ দিন পর বাবা ঠিক করলেন, আমাকে নিয়ে বাড়ির দিকে যাবেন। আমরা রওনাও হলাম। কিছু দূর আসার পর পড়লাম পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে!

ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম। বাবাও যে ভয় পাচ্ছেন, তা টের পেলাম।

পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি মুসলমান?’

বাবা বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি মুসলমান।’

‘কালেমা পড়ো।’

বাবার সঙ্গে আমিও কাঁপা কাঁপা গলায় কালেমা তাইয়েবা পড়তে লাগলাম। পাশেই ছিল নারকেলগাছ। পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে বলল, ‘ডাব পাড়ো।’

বাবা বললেন, ‘আমি ডাব পাড়তে পারি না।’

পাকিস্তানি সেনারা বলল, ‘ডাব পাড়বি কি না, বল!’

বাবা আর কথা না বাড়িয়ে ডাব পাড়তে উঠলেন।

ঠিক সে সময় কিছুটা দূরে আমাদের মতো কজন অসহায় বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীকে দেখেই দিল দৌড়। আর পাকিস্তানি সেনারাও তা খেয়াল করে গুলি ছুড়তে শুরু করল। ওদের মনোযোগ তখন ওদিকেই।

এই ফাঁকে বাবা গাছ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে আমাকে নিয়ে পালিয়ে এলেন।