আমরা অনেকে প্রতি মাসের শুরুতে প্রতিজ্ঞা করি-এই মাস থেকে যেভাবেই হোক কিছু টাকা জমাব। কিন্তু মাস শেষে হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখি পকেট প্রায় খালি। বড় কোনো বিলাসিতা নয়, বরং ছোট ছোট খরচই গিলে নেয় পুরো বেতন। হুটহাট বাইরে খাওয়া, হয়তো পছন্দের পোশাক কেনা, কিংবা সন্তানের জন্য খেলনা কেনা। এভাবেই টাকাগুলো বেরিয়ে যায় পকেট থেকে আর সঞ্চয় থেকে যায় শুধু স্বপ্ন হয়ে। এর সমাধানও আছে। আর তা আপনি খুঁজে পাবেন শতাব্দীপ্রাচীন জাপানি এক পদ্ধতি কাকেবোতে। কী এই কাকেবো এবং কীভাবে এটা কাজ করে?
আক্ষরিক অর্থে ‘কাকেবো’ মানে হলো ‘পরিবারের হিসাবের খাতা’। যে খাতায় ঘরের প্রতিটি খরচ লিখে রাখা হয়। মুদি কেনাকাটা, মাসিক বাজার, ওষুধ, ঘরে সহায়তাকারীর বেতন, সন্তানের স্কুল ফি-সবকিছু। এই ধারণার সূচনা করেছিলেন জাপানের এক নারী সাংবাদিক হানি মোতোকো, ১৯০৪ সালে। কাকেবো পদ্ধতি আমাদের শেখায় কীভাবে প্রতিটি খরচের সিদ্ধান্তের পেছনে সচেতনতা গড়ে তুলে টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা যায়।
কাকেবো ধারণার মূল কথা হলো সঞ্চয়কে খরচের পরের বিষয় নয়, খরচের অংশ হিসেবে দেখা। আমরা সাধারণত সব খরচ মিটিয়ে শেষে যা থাকে, সেটাকেই সঞ্চয় ভাবি; তবে বাস্তবে দেখা যায়, মাস শেষে হাতে কিছুই থাকে না। কাকেবো ধারণা বলে, এই ভাবনাটাকেই উল্টে দিন-আগে সঞ্চয় করুন, তারপর যা থাকে, সেটাতেই জীবন চালান।
ধরা যাক, আপনার মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। আপনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, মাসে অন্তত ৩ হাজার টাকা সঞ্চয় করবেন। তাহলে বেতন হাতে পেয়েই প্রথম কাজ হবে ৩ হাজার টাকা আলাদা করে রাখা।
এখন আপনার কাছে ২৭ হাজার টাকাই হলো আসল মাসিক বাজেট। অর্থাৎ আপনি ‘যা বাকি থাকে তা দিয়ে সঞ্চয়’ করছেন না, বরং ‘সঞ্চয় ছাড়া যা বাকি থাকে, তা খরচ’ করছেন। এই একটি পরিবর্তনেই বদলে যেতে পারে সবকিছু।
১. মাসিক আয় ও আবশ্যিক ব্যয়ের তালিকা
প্রথমে কাগজ-কলমে লিখুন, মাসে আপনার মোট আয় কত। তারপর লিখুন নির্দিষ্ট ব্যয়গুলো; যেমন বাড়িভাড়া, ঋণ, বাজার খরচ, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট খরচ, সন্তানের স্কুল ফি ইত্যাদি। এসবই হবে আবশ্যিক ব্যয়।
২. সঞ্চয়কে ধরুন আবশ্যিক ব্যয় হিসেবে
আপনার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন, মাসে কত টাকা সঞ্চয় করবেন। ধরা যাক, ৩০ হাজার টাকায় আপনি ৩ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে চান। তাহলে ৩ হাজার টাকাকে বাজেটের শুরুতেই কেটে রাখুন।
৩. প্রতিদিনের খরচ লিখে রাখুন
খরচের হিসাব ফোনে নয়, খাতায় হাতে লিখুন। একটা ছোট খাতা বা ডায়েরি রাখুন, প্রতিদিন রাতে মাত্র ৫-১০ মিনিট সময় দিন। যেমন ২ আগস্ট কফি বা নাশতা: ২০০ টাকা, বিদ্যুৎ বিল: ৮০০ টাকা, বাজার: ১৫০০ টাকা। যখন আপনি লিখে রাখবেন, তখন প্রতিটি টাকার মূল্য বুঝতে শুরু করবেন। এই সচেতনতাই কাকেবোর আসল জাদু।
৪. খরচকে ৪টি ভাগে ভাগ করুন
আবশ্যিক: খাবার, সঞ্চয়, বাড়িভাড়া, পরিবহন, ইউটিলিটি বিল ইত্যাদি।
ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল: এসব খরচ জীবনকে আনন্দ দেয়, কিন্তু অপরিহার্য নয়। যেমন শখের কেনাকাটা, রেস্তোরাঁয় যাওয়া, বিনোদন খাতে ব্যয়, ভ্রমণ ইত্যাদি।
সাংস্কৃতিক: জীবনে আত্মোন্নয়ন প্রয়োজন, যেমন বই কেনা, কোনো কোর্স করা, সিনেমা দেখা ইত্যাদি।
অতিরিক্ত: হঠাৎ জরুরি প্রয়োজন হতে পারে, সে জন্য আলাদা সঞ্চয় করতে হবে। যেমন বিয়ের দাওয়াতে উপহার দেওয়া, চিকিৎসাবাবদ খরচ, উৎসব-পার্বণে অংশগ্রহণ, জরুরি পরিস্থিতি ইত্যাদি।
৫. মাস শেষে নিজের হিসাব পর্যালোচনা করুন
মাসের শেষে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, কতটা সঞ্চয় করতে পারলাম? লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? কোথায় বেশি খরচ হয়েছে, আর কোথায় খরচ কমানো সম্ভব? পরের মাসে কীভাবে আরও ভালো করা যায়? উদাহরণ দেখুন-
আয়: ৩০ হাজার টাকা
সঞ্চয়: ৩ হাজার টাকা
এখন মোট আয়: ২৭ হাজার টাকা
মোট ব্যয়: ২৮ হাজার ২০০ টাকা
ফলাফল: মাইনাস ১ হাজার ২০০ টাকা
অর্থাৎ এই মাসে খরচ বেড়েছে, পরের মাসে বাইরে খাওয়া একটু কমাতে হবে।
কাকেবো শেখায় সঞ্চয় কোনো জাদু নয়, এটা একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ ও চর্চার বিষয়। এটি আপনাকে শেখায় নিজের টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ কীভাবে রাখা যায়।
১. আপনি ‘পারেতো নীতি’ও ব্যবহার করতে পারেন। পারেতো নীতি হলো আপনার মোট খরচের ৮০ শতাংশ কোথা থেকে আসছে, সেটা আগে বের করা। তারপর সেখান থেকে ছোট ছোট কাটছাঁট করে বড় সঞ্চয় করা সম্ভব।
২. আর ছোটখাটো অপ্রয়োজনীয় খরচের (যেমন প্রতিদিনের চা-কফি, নাশতা বা নানা সাবস্ক্রিপশন ইত্যাদি।) ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করুন জাপানি ধারণা ‘মুদা’। এই ‘মুদা’ মানে হলো অপ্রয়োজনীয় ব্যয় দূর করা।
সবশেষে
হানি মোতোকো এক শতাব্দী আগেই দেখিয়েছিলেন, সঞ্চয়ের শুরু হয় খরচের হিসাব থেকে, আর খরচের হিসাবের শুরু সচেতনতা থেকে। তাই এখনো কাকেবো মনে করিয়ে দেয়-‘হিসাব রাখুন, সচেতন থাকুন, সঞ্চয় করুন।’
সূত্র: মিডিয়াম