চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে ট্রেন চালানোর সময়টা সব সময়ই সতর্ক থাকি। কেননা এখানে হাতি চলাচল করে। কখনো কখনো লোহাগাড়ার রেললাইনেও উঠে পড়ে হাতির পাল। এ জন্য এখানে ট্রেনের গতিও রাখি কম। বিশেষ করে চার কিলোমিটার পথে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি থাকে ২০ কিলোমিটার।
গত মঙ্গলবার রাতে কক্সবাজার থেকে ‘সৈকত এক্সপ্রেস’ ট্রেন চালিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। ট্রেনে প্রায় ৫০০ যাত্রী। লোহাগাড়া-হারবাং সেকশনে যখন প্রবেশ করি, তখন রাত ১০টা ২৫ মিনিট। এই জায়গাটাতে আবার রেলপথ বাঁক নিয়েছে। বাঁক নেওয়ার সময় ট্রেনের হেডলাইটের আলোতে সামনের রেলপথ দেখা যায়। সেই আলোতে দেখতে পাই রেললাইনের ওপর একটি হাতি দাঁড়িয়ে আছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়িনি। তাই মুহূর্তের জন্য বিচলিত হয়ে পড়ি। তবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিই। ট্রেনের ব্রেক চাপতে থাকি। এরপর ইমার্জেন্সি বা জরুরি ব্রেক চেপে ধরি। শঙ্কা ছিল কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে যায়। তবে ভাগ্য সহায়। হাতি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, তার ঠিক আগে গিয়ে ট্রেন থেমে যায়।
রেললাইন থেকে হাতিকে সরে দাঁড়ানোর জন্য ঘনঘন হুইসেল দিতে থাকি। একসময় হাতিটি রেললাইন থেকে নিচে নেমে যায়। সেখানে আরও কয়েকটি হাতি ছিল। এর মধ্যে ট্রেনের একেবারে পেছনের বগিতে থাকা গার্ড (পরিচালক) সাখাওয়াত হোসেন ফোন করেন, তাঁর বগির দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা দিচ্ছে একটি হাতি। তাঁর কণ্ঠে আতঙ্ক। বগির দরজার ছিটকিনিও ভেঙে গেছে।
গার্ডের ফোন পেয়ে আমি নিজেও চিন্তায় পড়ে যাই, ট্রেনে প্রায় ৫০০ যাত্রী। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয় আছে। দ্রুত ট্রেন ছাড়তে বলেন গার্ড। আমিও সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দিই। শেষ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। নির্বিঘ্নেই ট্রেন চালিয়ে এলাকা ছেড়ে আসি আমরা। সব মিলিয়ে মাত্র ৪ থেকে ৫ মিনিট, তার মধ্যেই এতসব ঘটনা!
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের লোহাগাড়া-হারবাং অংশে হাতি কিন্তু এবারই প্রথম আসেনি। একবার তো ট্রেনের ধাক্কায় একটি হাতি মারাও গিয়েছিল। এবারও সে পরিস্থিতি হতে যাচ্ছিল। হাতি তো অবুঝ প্রাণী। ওরা রেললাইন দিয়েই বনের এপাশ–ওপাশ করবে। তাই এটা নিয়ে ভাবতে হবে। বিকল্প কী করা যায়, বের করতে হবে।
চাকরিজীবনে এ ধরনের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ২০০৪ সালে রেলওয়েতে যোগ দিই। ট্রেন চালানোর সময় রেললাইনে কখনো কখনো গরু-ছাগল এসে পড়েছে। ছোট-খাটো দুর্ঘটনাও ঘটেছে। তবে এবারের মতো রেললাইনে হাতি চলে আসার মতো পরিস্থিতির মুখে কখনো পড়িনি। অবশ্য দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছি। হাতির জীবনরক্ষা করেও যাত্রীদের নিরাপদে নিয়ে আসায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মানুষও বাহবা দিয়েছেন। আর কক্সবাজার রেলপথ নিয়ে আমার অন্য রকম অনুভূতি আছে। কক্সবাজার রেলপথে প্রথম যে ট্রেন চলাচল করেছিল, তার চালকদের একজন ছিলাম আমি। তাই নিজের মধ্যে বরাবরই একটি বিশেষ আবেগ কাজ করে। এখন হাতির জীবন রক্ষা করতে পারায় আরও বেশি আনন্দ লাগছে।
অনুলিখন: সুজন ঘোষ