ফেসবুক এখন সরগরম এক রেস্তোরাঁ নিয়ে। যে রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে নাকি ডাক্তারের চেম্বারের মতো ওয়েটিং জোনে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়। ঢাকা শহরের অলিগলিতে হাজারো খাবারের রেস্তোরাঁ আছে, তবে এই রেস্তোরাঁর এমন কী বিশেষত্ব আছে যে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন নেটিজেনরা। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা হাজির হয়েছিলাম ঢাকার মহাখালীর ‘দূরবীন বাংলা’য়।

ভাইরাল এই রেস্তোরাঁর খাবার নিয়ে কেউ বানাচ্ছেন রিল, কেউ দিচ্ছেন অন্দরসজ্জার রিভিউ, কেউবা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর খাবার টেবিল পেয়ে বিজয়ীর হাসির ছবি জুড়ে দিচ্ছেন স্টোরিতে।
দূরবীন বাংলায় না খেলে নাকি এখন চলতি ধারায় থাকা যায় না, এমনটাই বলেন সামিয়া হোসেন হৃদি। মোহাম্মদপুর থেকে পরিবার নিয়ে খেতে এসেছেন। ‘খাবার তো ভালো লেগেছে, বেশি ভালো লেগেছে এখানকার পরিবেশ’, এমনটাই বলেন সামিয়া। ‘আমরা যাঁরা মহাখালীতে থাকি, তাঁদের জন্য আড্ডা দেওয়ার মতো জায়গার বেশ অভাব। দূরবীন বাংলা সেই সুযোগ করে দিল।’ কথা হচ্ছিল মহাখালীর স্থায়ী বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে প্রায়ই তিনি চলে আসেন এখানে।
দূরবীন বাংলার ওয়েটিং জোনের চেয়ারে অপেক্ষা করছিলেন সৌমি আহমেদ। বলছিলেন আধা ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি। টেবিল খালি হলেই বসার ব্যবস্থা হবে। এতে কি সময় নষ্ট হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভালো খাবারের জন্য এটুকু সময় নষ্ট কিছুই নয়।
ফোনে আগে থেকে জেনে নিলেও দূরবীন বাংলার লোকেশন খুঁজতে কিছুটা বেগই পেতে হলো। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ক্যাম্পাসের বিপরীত গলিতে না ঢুকলে বাইরের রাস্তা থেকে এই রেস্তোরাঁ খুঁজে পাওয়া একটু কষ্টকরই। তবে ভাইরাল বলে কথা। যেকোনো রিকশাওয়ালা মামা থেকে শুরু করে চায়ের দোকানদার, যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবে রেস্তোরাঁর ঠিকানা। গলিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল পরিপাটি একতলা একটি বাড়ি। যদিও এটি আগে নিটল টাটা গ্রুপের মোটরসাইকেল পার্কিং জোন ছিল। দূর থেকে অপেক্ষমাণ গাড়ির সারি বলে দিচ্ছিল যে ফেসবুকে দেখা রিভিউ আসলেই ভুল নয়।
স্থাপত্যশৈলী দেখেই বোঝা গেল, বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করে সাজানো হয়েছে এই রেস্তোরাঁ। প্রবেশমুখে রাখা আছে বাঁশের বেঞ্চ। শুধু বাইরেই নয়, রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জায়ও সেই ছাপ সুস্পষ্ট। অন্দরসজ্জায় বাসনকোসনের ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে কেটলি ও বাঁশের ল্যাম্পশেড। রেস্তোরাঁয় যে আলো–আঁধারির আবহ আনা হয়েছে, এটিই পরিবেশে এনে দিয়েছে আলাদা বিশেষত্ব।
কথা হলো দূরবীন বাংলার ম্যানেজার দেবাশীষ বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি জানান, দাপ্তরিক ও বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ার কারণে এ ধরনের রেস্তোরাঁর একটা চাহিদা ছিল। এই ভাবনা থেকেই মহাখালীতে দূরবীন বাংলার যাত্রা শুরু করেন। তিনি আরও যোগ করলেন, পুরোপুরি বাড়ির রান্নার আবহ পাওয়া যাবে দূরবীন বাংলার খাবারে। রান্নায় পরিমিত মসলা, তেল ও ঝালের ব্যবহার করা হয়। প্রথম দিন সকালে যখন গিয়েছি, তখন সময় সকাল আটটা। দেখলাম, খাবারের প্রায় প্রতিটি টেবিলই পরিপূর্ণ। কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে খেতে, কেউবা অফিসে ঢোকার আগে নাশতা সেরে নিচ্ছিলেন।
ফেসবুকে দূরবীন বাংলা রেস্তোরাঁ নিয়ে যে কনটেন্টগুলো চোখে পড়ছে, তার মধ্যে আছে ১ হাজার টাকায় দুজনের খাবার, ১৪০ টাকায় সম্পূর্ণ হবে সকালের নাশতা বা ২৩০ টাকায় মিলবে পোলাও–মাংস। বেশির ভাগ কনটেন্টে খাবারের রিভিউর পাশাপাশি উঠে এসেছিল এখানকার খাবারের কম দামের বিষয়টি। আসলেই কি দূরবীন বাংলার খাবার কিছুটা সস্তা? জানতে চাইলে দেবাশীষ বিশ্বাস জানান, সব ধরনের মানুষ যাতে দেশীয় খাবারের স্বাদ পায়, সে কারণেই দূরবীন বাংলার মেনু কার্ডে খাবারের দাম কিছুটা সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছেন। সাধারণত এ ধরনের রেস্তোরাঁগুলোয় খাবারের দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে দূরবীন বাংলা ব্যতিক্রম বলা যেতেই পারে।
সব সময় ভিড় থাকলেও দূরবীন বাংলার নাশতার হাইপটা যেন একটু বেশি বলা চলে। মাখন চিকেন স্যুপ বা ঘি মালাই সুজি এখানকার ব্রেকফাস্টের অন্যতম ভাইরাল পদ। আরও আছে সবজি গুলিস্তান আর নরম–গরম মগজ। জানা গেল, এখানকার প্রায় প্রতিটি রান্নায় ব্যবহার হয় খাঁটি গাওয়া ঘি। প্রতি বেলায় আছে গরম–গরম রসগোল্লার আয়োজন, যা এখানেই ময়রাদের হাতে বিশেষভাবে তৈরি হয়।
আড়ং যেমন বাংলাদেশি পণ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছে, তেমনি বাঙালি খাবারের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করার ইচ্ছা আছে, এমনটাই বলেন দূরবীন বাংলার উদ্যোক্তা ও কর্ণধার সাফিন বেগ। রেস্তোরাঁর নামটিও তাঁর দেওয়া। দূরবীন দিয়ে যেমন আমরা অনেক দূরের জিনিসকে কাছে দেখতে পাই, তেমনি অনেক দিন খাওয়া হয় না, এমন সব বাংলা খাবারের স্বাদ মিলবে এখানে। অনেকটা রূপক অর্থে নামটি দেওয়া বলে জানান তিনি।