২০২৩ সালের মে মাসে অন্তর্জালের দুনিয়ায় ভেসে ওঠে ‘নাস ডেইলি’ ইউটিউব চ্যানেলের নতুন ভিডিও। নুসের ইয়াসিনের অনেক ভিডিওর মতোই সেখানে ছিলেন তাঁর প্রেমিকা ‘ডিয়ার এলিন’–এর এলিন তামির। তবে অন্য সব ভিডিও থেকে সেই ভিডিও ছিল আলাদা। সেখানে ছয় বছর সম্পর্কে থাকা এই জুটি ঘোষণা দেন বিচ্ছেদের। কেবল ফেসবুকেই এই ভিডিও দেখা হয়েছে প্রায় ৩ কোটি বার। এটি ‘নাস ডেইলি’র সবচেয়ে বেশি ভিউ হওয়া ভিডিওগুলোর একটি।
এলিনের মতে, নুসের কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানই প্রাধান্য পেয়েছে। নাস তাঁকে সময় দিতে পারছিলেন না। এলিন বলেন, ‘আমি ছয় বছর ওর জন্য অপেক্ষা করেছি। শেষ দুই বছর তো ওর আমার কথা প্রায় মনেই পড়েনি। আমি নিজের সবকিছু ফেলে ওর পৃথিবীতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আর কত ত্যাগ স্বীকার করব? এবার নিজের জীবনে মনোযোগী হতে চাই।’
এ ছাড়া বিয়ে, একসঙ্গে থাকা বা সন্তান নেওয়ার মতো মৌলিক বিষয়গুলোতেও একমত হতে পারছিলেন না নাস ও এলিন। সম্পর্কে থিতু হতে চাইছিলেন এলিন, এদিকে নাসের প্রাধান্য ছিল তাঁর পেশাজীবন। দুই বছর পরও ভক্তদের অনেকে এখনো মেনে নিতে পারেন না এই বিচ্ছেদ।
২০২৪ সালের নভেম্বরে আরেকটি ভিডিওর মধ্য দিয়ে নাস ডেইলির নুসের ইয়াসিন তাঁর নতুন প্রেমিকা আইজা মেরকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। নিজেদের প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে নাস বলেন, ‘একদিন আমার এক মার্কিন বন্ধুকে বলছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ আর বড় জয় সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া। আজকাল কি আর সত্যিকারের প্রেম মেলে?’
নাসের সেই বন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘তুমি আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতে পারো।’
তারপরই নাস তাঁর সেই বন্ধুর কাছ থেকে আইজা মেরকের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের খোঁজ পান। বাকিটা শোনা যাক নাসের মুখেই, ‘ইনস্টাগ্রামে আইজার ছবি দেখেই প্রেমে পড়ে গেলাম। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে! সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ করলাম। কিছুদিন পরই নিউইয়র্কের একটা নিরামিষাশী রেস্তোরাঁয় আমরা দেখা করি। সেটা ছিল আমার জন্য ফার্স্ট ডেট। এরপর আবারও আরেকটা রেস্তোরাঁয় দেখা করি। তারপর আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে শুরু করি। আর মাসের পর মাস পার করে নিশ্চিত হয়েছি, আইজা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, আমার প্রেমিকা, আমার জীবনসঙ্গী।’
উল্লেখ্য, নাসের প্রথম প্রেমিকা এলিনই তাঁকে নিরামিশাষী হতে অনুপ্রাণিত করেন। বিষয়টি নিয়ে এলিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে নাস একাধিক ভিডিও-ও বানিয়েছেন।
নাস ডেইলির সাবেক প্রেমিকার মতো আইজা মেরকও মার্কিন-ইসরায়েলি কনটেন্ট ক্রিয়েটর। আইজার বাবা মুসলিম, মা ইহুদি। ২৯ বছর বয়সী আইজার জন্ম ও বেড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রে।
নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করেছেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে লেখা আইজার প্রথম বই ‘দ্য সারভাইভাল গাইড টু বুলিং’ নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার। তাঁর দ্বিতীয় বই ‘ডিয়ার গার্ল’।
এ ছাড়া আইজা ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখেন। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন, টাউন হল, লস অ্যাঞ্জেলেসের মাইক্রোসফট থিয়েটার ও জাতিসংঘের সম্মেলনে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছেন।
লেখালেখির পাশাপাশি আইজার নিজের একটা প্রতিষ্ঠান আছে, যেটি তারুণ্য ধরে রাখা ও দীর্ঘায়ু নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া আইজা মানসিক স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও কাজ করছেন।
নাসের জন্মদিনে তাঁকে কী উপহার দেওয়া যায়, তাই ভাবছিলেন আইজা। এক ভিডিওতে তিনি বলেন, ‘নাস এমন একজন, যে দুটি প্যান্ট আর একই রকম দেখতে দুটি টি-শার্ট পরেই সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়ায়। ও মোটেই বস্তুবাদী নয়। তবে ও এআই নিয়ে অবসেসড। তাই আমি ওর জন্য বিশেষ একধরনের এআই অ্যাপ বানালাম। সেখানে আমি নাসকে ভালোবাসার ৩৬৫টি কারণ লিখলাম। নাস যখন চাইবে, এআইকে জিজ্ঞেস করবে যে আইজা আমাকে কেন ভালোবাসে? এআই একটা একটা করে কারণ দেখাবে। তারপর নাস সেই অ্যাপে লিখল, “আমাকে ভালোবাসার প্রথম কারণটা কী?” এআই বলল, “তুমি যেভাবে শিশুর মতো কৌতূহলী চোখে বিশ্বকে দেখো আর আনন্দে উত্তেজিত হয়ে যাও, আমি সেটা ভালোবাসি।”’
নাস বলেন, ‘এটা আমার জীবনের সেরা উপহার।’
নাস ডেইলি ভ্লগের কারণে নুসের ইয়াসিন ‘নাস’ নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত। ইউটিউবে তাঁর নাস ডেইলি চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ১ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। নাসের জন্ম ইসরায়েলে, এক মুসলিম ফিলিস্তিনি পরিবারে। ২০২২ সালের আগপর্যন্ত নাস নিজেকে বলতেন, ‘আমি আগে ফিলিস্তিনি, তারপর ইসরায়েলি।’
২০২২ সালে দুবাইয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেকে ‘ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি’ বলে পরিচয় দেন। একই বছর সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নাগরিকত্ব পান। ফলে এখন তিনি ইসরায়েলি-কিটিটিয়ান। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে নাস এক টুইটে লেখেন, ‘আমি আগে ইসরায়েলি, তারপর ফিলিস্তিনি।’
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রেক্ষিতে এই টুইট ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। এর ভেতর দিয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে নাসের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথমে বিচ্ছেদ ও একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে পরবর্তী কয়েক মাসে কয়েক লাখ সাবস্ক্রাইবার কমে যায় নাসের। এর কিছুদিন পর ইসরায়েলের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাসকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় তুখোড় মেধাবী নাস অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর তাঁরা কয়েক বন্ধু মিলে ‘পে ইট ফরওয়ার্ড’ নামে একটি রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস ও সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে মোবাইল পেমেন্ট সার্ভিস ‘ভেনমো’তে সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে চাকরি নেন।
২০১৬ সালে হুট করেই চাকরি ছেড়ে একটা এলএসআর ক্যামেরা নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হন। তখন থেকে তিনি টানা এক হাজার দিন ১ মিনিটের ১টি করে ভিডিও পোস্ট করেছেন। প্রতিটি ভিডিও বানাতে ৬ ঘণ্টা শুটিং করতেন, আর ৩ ঘণ্টায় করতেন এডিটিং ও পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ।
প্রতিটি ভিডিওর শেষে বলতেন, ‘দ্যাটস ওয়ান মিনিট, সি ইউ টুমরো’। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নাস ডেইলির সাবস্ক্রাইবার ১ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করে। এসব ভিডিওর বেশ কয়েকটিতে নাসের সঙ্গে দেখা গেছে এলিনকে।
ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও নাস বেশ কয়েক বছর সিঙ্গাপুর থেকেছেন। আর এখন থাকছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। সেখান থেকেই এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁর প্রতিষ্ঠান নাস ডেইলি করপোরেশনের কাজ। ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নাস একাডেমি। এ ছাড়া নাসের আছে হোটেল ব্যবসা। ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন সিক্সটি সেকেন্ডস’ নামে একটি স্মৃতিকথামূলক বইও লিখেছেন।
নাসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন এলিন। ইতিমধ্যে ১ হাজার ঘণ্টা থেরাপি নিয়েছেন। থেরাপি কীভাবে তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করেছে, সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন ভক্তদের সঙ্গে। সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিরতি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর লেখালিখি করেছেন।
আগের মতোই প্রাণী, প্রকৃতি, পরিবেশ আর টেকসই জীবন নিয়ে কাজ করছেন। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন এলিন। ‘ডিয়ার এলিন’ পেজে পোস্ট করছেন নানা ধরনের ভিডিও। এখনো তাঁর রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ‘সিঙ্গল’। সম্প্রতি ‘ডিয়ার এলিন: মাই ইয়ার্স অ্যাজ আ ম্যারিড ভার্জিন’ নামে একটি বইও লিখেছেন।
নাসের নতুন প্রেমিকাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভিডিওর নিচে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নেটিজেনরা। তাঁদের একটা অংশ শুভকামনা জানিয়েছেন এই জুটিকে। তবে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করতে কোনো রাখঢাক রাখেননি। একজন লিখেছেন, ‘বিচ্ছেদের ভিডিওর অপেক্ষায় রইলাম।’
আরেকজন লিখেছেন, ‘ভিডিও দেখে মনে হচ্ছে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন, দুজনের মধ্যে কোনো রসায়ন নেই। কেবল ব্যবসায়িক স্বার্থে একজন আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করছেন!’
আরেকটা মন্তব্য এ রকম, ‘নতুন প্রেমিকাকে দেখতে একেবারে এলিনের (সাবেক প্রেমিকার) মতো। মনে হচ্ছে এলিনের যমজ বোন। সে–ও একজন নিরামিষাশী কনটেন্ট ক্রিয়েটর মার্কিন–ইহুদি। মনে হচ্ছে, প্রাক্তনকে নাস ভালোই মিস করছে!’
একজন লিখেছেন, ‘সাবস্ক্রাইবার, ভিউ, রিচ কমে গেছে; তাই নতুন প্রেমিকার আবির্ভাব! কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের জীবন এমনই। প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ—সবকিছুই তাঁদের কাছে কেবলই কনটেন্ট।’ আরেকজন আইজাকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘সে একটা আস্ত রেড ফ্ল্যাগ! সময় থাকতে ভাগোওও!’
সূত্র: এমএসএন