এক মাকে পেতে গিয়ে আরেক মাকে পাওয়া হলো না

যে মায়ের জন্য আজকের আমি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কখনো কোনো মায়ের গান, মাকে নিয়ে লেখা কবিতা বা মাকে নিয়ে কোনো আলোচনায় আর সবার মতো আমি আমার নিজের মাকে কল্পনা করে আবেগপ্রবণ হতে পারতাম না। কারণ, প্রায় ১৫–১৬ বছর বয়সেও আমি বুঝতাম না, আমার মা আসলে কোনজন?

আমার মা যে দুইটা! না না, বাবা আমার দুই বিয়ে করেননি। বাবাও তো আমার দুইটাই।

ছোটবেলায় যখন কেউ আমার মা-বাবার নাম বা কী করেন জানতে চাইতেন, আমি প্রথমে তাকিয়ে থাকতাম। একেক সময় একেক রকম উত্তর দিতাম।

রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় আমাকে যিনি স্নান করিয়ে দেন, পোশাক পরিয়ে, খাইয়ে, নিজে রিকশা করে স্কুলে দিয়ে আসেন, তিনি কি আমার মা? নাকি প্রতিবছর স্কুল শেষের ছুটিতে কদিনের জন্য যাঁর কাছে যাই, যিনি আমাকে কাছে পেলেই পাগলের মতো উতলা হয়ে যান, মমতায় ভরিয়ে রাখেন, তিনি আমার মা?

দুজনকেই তো আমি ‘মা’ বলে ডাকি।

প্রথম মা আমাকে শাসনও করলেও দ্বিতীয়জন তো শাসন করার সময়-সুযোগ পান না। সারা বছর তীর্থের কাকের মতো আমার আশায় পথ চেয়ে বসে থাকা মানুষটার তো শাসন করার কথাও নয়। আমারও যে তাঁর জন্য মন কাঁদে খুব। কিন্তু যে মায়ের কাছে বড় হয়েছি, তিনি যে কষ্ট পান, যদি ওই মাকে জড়িয়ে ধরি। কয়েকটা দিন থাকার পর তাঁর কাছ থেকে চলে আসার সময় ছোট্ট আমার বুকের ভেতর খামচি দিয়ে গলা টিপে বসে থাকত ভয়াবহ এক যন্ত্রণা। তাঁর কাছ থেকে আসতে চাইতাম না। তবু অনেক কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে একটুও না কেঁদে প্রথমজনের হাত ধরে শহরে ফিরে আসতে হতো। অবশ্য কিছুদিন পরই সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যেত। শহরের মায়ের আদর-যত্নে একটা সময় ঝাপসা হয়ে যেত আমার পথের পানে তাকিয়ে থাকা মফস্‌সলের মায়ের মুখ।

বড় হতে হতে এই দুই মায়ের ব্যাপারটা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম। শহরে যে মায়ের কাছে আমি থাকি, তিনি আমাকে গর্ভে ধারণ করেননি। বিয়ের পর কম বয়সেই ক্যানসারের কারণে তাঁর জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়। অপারেশনের পর যখন জানতে পারলেন যে তিনি আর কখনো মা হতে পারবেন না, তখন নাকি তাঁকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। পরিবারের লোকেদের কাছেই শোনা, তখন নাকি অচেতন অবস্থায় তিনি আমার নাম ধরে ডাকতেন। তাঁর চিকিৎসক জানতে চান, ‘রোগী যার কথা বলছেন, সে কোথায়? তাকে জলদি নিয়ে আসুন। না হলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।’

এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সন্ধ্যাবেলায় উঠোনে তিন বোনের সঙ্গে খেলছি। গায়ে একটা কালো ফুল-ফুল জামা আর মাথায় দুটো কলাবেণি। এমন সময় বাবা এসে বললেন, ‘চল খুকি, তোকে এখনই ঢাকায় যেতে হবে।’ মা জানতে চাইলেন, ‘মেয়েকে কোথায় নিয়ে চললে?’

সিরাজগঞ্জ থেকে চার বছরের মেয়েকে নিয়ে এসে বাবা তুলে দিলেন যাঁর হাতে, তিনি আমার পিসি, মানে বাবার বোন। আমাকে পেয়ে পিসি যেন প্রাণ ফিরে পেলেন। তবে কবে আমি পিসিকে ‘মা’ বলা শুরু করলাম, এখন আর তা মনে পড়ে না। ‘মা’ ডাকার জন্য নাকি আমাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আগে পিসি বাড়িতে গেলেই আমার জন্য খেলনা, খাবার, ছবির বই, এটা-ওটা নিয়ে যেতেন। খুব আদর করতেন। আমিও তাঁকে খুব পছন্দ করতাম।

গর্ভধারিণীর সঙ্গে

সেই সন্ধ্যার পর যেমন এক মায়ের জীবন বাঁচল, তেমনি সন্তানকে হারিয়ে বুক চাপড়ে অজ্ঞান হলেন আরেক মা, আমার জন্মদাত্রী।

এরপর নতুন মায়ের কাছেই থেকে গেলাম। আমাকে পেয়ে বাউন্ডুলে ধরনের এই ‘বাবা’ (আমার পিসামণি) সংসারী হলেন। নতুন বাসা নিলেন। আসবাব, ঘরের দরজা-জানালার পর্দাসহ সবকিছুই নতুন। একটা সন্তানকে ঘিরে দুজনের কত নতুন স্বপ্ন। নতুন করে জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেলেন তাঁরা। এই মা-বাবা দুজনই দুই হাতে অর্থ ব্যয় করেছেন আমার জন্য। কোনো দিন কিছু চাইতে হয়নি আমাকে। সব প্রয়োজন মিটিয়েছেন তাঁরা। মধ্যবিত্ত পরিবারে অর্থাভাব যে ছিল না, তা তো নয়। প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার আগে আমার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার জন্য চাকরি ছাড়লেন মা। তখন বাবা দুটো টিউশনি বাড়ালেন। দুজন মানুষ দিন-রাত এক করে মেয়েকে মানুষ করার মিশনে নেমেছিলেন যেন।

পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। পাশাপাশি নিজের মতো করে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত করলেন মা। নানা রকম অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। অবাক হয়ে মঞ্চ দেখতাম, গান-কবিতা শুনতাম আর নিজের মনেও স্বপ্ন বুনতাম। মায়ের কারণে স্বপ্ন দেখা শিখলাম। মা গান শুনতেন খুব। সেটা তো ছিল ফিতা ক্যাসেটের যুগ। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাগর সেন, মান্না দে, কিশোর কুমার, চিত্রা সিং, হেমন্তদের সঙ্গে পরিচয় হলো। তারপর আধো আধো বোলে কবিতা আবৃত্তি শুরু করলাম। মা-ই মুখস্থ করিয়ে দিতেন। হাত-পা নাড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে ছড়া বলা শেখাতেন। দুই-একটা প্রতিযোগিতায় যেতে শুরু করলাম। মঞ্চে উঠে ছড়া-কবিতা বলতাম। দর্শকসারিতে মা বসে থাকতেন আকুল উদ্বেগ নিয়ে। সকাল-সন্ধ্যা আমাকে পড়ানো, ভালো ভালো খাওয়ানো, ভালো ভালো শিক্ষক, আমার দেখাশোনার জন্য বাসায় সার্বক্ষণিক সাহায্যকারী...আমার জন্য মায়ের কত চেষ্টা, কত পরিশ্রম, কত যত্ন!

আমাদের বাসা ছিল নারায়ণগঞ্জে। ঢাকায় বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একদিন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে বললাম, স্যার, এই যে বই পড়ি, প্রতি শুক্রবার বই পড়ার জন্য এক জেলা থেকে আরেক জেলায় আসি, মা তো বোঝেন না। রাগারাগি করেন। স্যার বললেন, মা এখন কোথায়? আমি বললাম, মা বাইরে বসে আছেন। ক্লাস শেষ হলে নিয়ে যাবেন। স্যার ধমক দিয়ে বললেন, ‘অকৃতজ্ঞ! মা বুঝুক আর না বুঝুক, নিয়ে তো এসেছেন। আর কী চাস?’ এ ঘটনা পরে মাকে বলার পর তিনি হেসেছিলেন শুধু। শীতের দিনে আমি ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখেছি, আমার জন্য গরম জল তৈরি। বাসায় জল নেই? হাঁটুর ব্যথা নিয়েও মা চারতলায় জল টেনে তুলতেন আমার জন্য।

সেই মা আমার এখন বুড়ো হয়েছেন। এখন তিনিই শিশু আর আমি তাঁর মা। বাবা তো আমার দুটো পা, মাথা আর মেরুদণ্ড শক্ত করার কাজটা সম্পন্ন করেই চিরছুটিতে চলে গেছেন। এখন মাকে নিয়েই আমার পৃথিবী। ভদ্রমহিলা কানে শোনেন না। মেশিন লাগানো না থাকলে কানের কাছে মুখ নিয়ে একটা কথাই বারবার বলতে হয়। বুঝল কি না, পরখ করতে হয়। কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না, ভুলে যান। বহুকাল আগের টিউমার আর ক্যানসার এবং সারা জীবনের ডায়াবেটিস, থাইরয়েডে তিনি জেরবার। আরও আছে অস্টিওআর্থ্রাইটিস, ঠান্ডা লাগার বাতিক, জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, পেট খারাপ, যখন-তখন বমি, ক্রিয়েটিনিন, ইউরিক অ্যাসিড, কী নেই! ইউরিন ইনফেকশন তো লেগেই আছে। কাজেই তাঁর পেছনেই ব্যয় হয়ে যায় বড়বেলার আমার সব শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সামর্থ্য।

একটা সময় রিকশায় বসে হুডের অপর প্রান্তে হাত দিয়ে ধরে আমায় আগলে রাখতেন মা। আর এখন রিকশায় বসলে হুডের অপর প্রান্তে হাত দিয়ে তাঁকে আগলে রাখি আমি। তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যাই, তাঁর সঙ্গে গল্প করার জন্য একে-ওকে ধরে বাসায় নিয়ে আসি। এসব গল্প করার পর অনেকেই আমাকে বলেন, ‘ও–ও–ও, তার মানে এই মা তোমার আসল মা নয়, এই মা হলেন....।’

না, মায়ের কোনো আসল-নকল হয় না। মা মা–ই।

কিন্তু গর্ভধারিণীর জন্য যে মনটা পোড়ে। আহা! আমার জননীর যে দেখা হলো না আমার বেড়ে ওঠা। শরীর এক জায়গায় আর আত্মা আরেক জায়গায় থাকার যাতনা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে! গর্ভধারিণী মাকে একটু-আধটু কাছে পাই কদাচিৎ। কিন্তু একজীবনে যে পাওয়া হলো না তাঁকে। যাঁর কাছে বড় হয়েছি, তাঁর জন্য কত-না যত্ন, কত সামাজিকতা, কত দায়িত্ব! আর যিনি জন্ম দিলেন, তিনি তো বহু দূরে। যখন খুশি মন চাইলেই ছোঁয়া যায় না তাঁকে, জড়িয়ে ধরতে পারি না। কাছে থাকলেও লজ্জা করে। তাঁকে বলা হয় না, খুব কষ্টে তোমাকেও যে পেতে ইচ্ছা করে, মা! মায়ের নামের জায়গায় তোমার নামটা পর্যন্ত লেখা নেই। লোকে জানে না আমার গর্ভধারিণীর নাম। রোজ রোজ ‘ক্ষুধা লেগেছে, খেতে দাও’ তোমাকে বলা হয় না। কত কথাই তো বলা হলো না। একটা জীবন কেটে গেল; এক মাকে পেতে গিয়ে আরেকজনকে যে পাওয়া হলো না, মা...