মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ম্যানিপুলেটর’ এমন এক ব্যক্তি, যে নিজের সুবিধা হাসিল করার জন্য অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করে। এ ধরনের মানুষের সাহচর্য আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মমর্যাদার জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে এ ধরনের মানুষের সঙ্গে প্রেম কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যিনি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন, তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না যে তাঁকে কেউ শুধু নিজের স্বার্থে ক্রমাগত ব্যবহার করে যাচ্ছে। তাই সময় থাকতেই ম্যানিপুলেটরদের চেনা প্রয়োজন।
মনোবিজ্ঞান থেকে জানা যায় ‘গ্যাসলাইটিং’ থেকে শুরু করে ‘লাভ বম্বিং’ পর্যন্ত নানা উপায়েই ম্যানিপুলেটররা অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এসব লক্ষণ দেখলেই সাবধান হয়ে যান। মানসিক শান্তির জন্য এসব ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। ম্যানিপুলেটর চেনার কিছু উপায় জেনে রাখুন—
‘গ্যাসলাইটিং’ অর্থ হলো নিজের ভুলের জন্য অপরকে দোষারোপ করা। ম্যানিপুলেটরদের অন্যতম স্বভাব হলো গ্যাসলাইটিং। নিজেদের ভুল স্বীকার না করে সত্যকে বিকৃত করায় এরা অত্যন্ত পারদর্শী। দেখা যায়, একটি ঘটনা ঘটেছিল একভাবে, কিন্তু তারা বর্ণনা করবে অন্যভাবে। এমনকি আপনি যদি অতীতে কোনো ভুল না-ও করে থাকেন, তারা এমনভাবে সবকিছু বর্ণনা করবে যে আপনার মনে হবে আপনিই হয়তোবা দোষ করেছিলেন, কিন্তু ভুলে গেছেন। এসবই তাদের গ্যাসলাইটিং প্রক্রিয়ার অংশ।
আপনি মনে করতে পারেন তারা আপনার বন্ধু। কিন্তু তারা প্রায়ই আপনার আবেগ-অনুভূতিগুলোকে আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে। আপনি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকলে, নিজের ব্যক্তিগত সীমারেখা মেনে চলতে চাইলেও আপনাকে তারা আপরাধবোধে ভোগাবে।
এরা আপনার সঙ্গে কখনোই কোনো কথা খোলামেলাভাবে বলবে না। এরা ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলবে, চুপচাপ থাকবে, সূক্ষ্মভাবে খোঁচা দিয়ে আপনাকে কষ্ট দেবে এবং আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে।
অনেক সময় আমরা কারও কারও আচরণে এত বেশি বৈপরীত্য খুঁজে পাই যে বুঝতেই পারি না তাদের আসল চেহারা আদতে কোনটা। প্রায়ই দেখা যায় সম্পর্কের শুরুতে একটা মানুষ আপনাকে সারা দিন টেক্সট পাঠাত, ‘খেয়েছ?’, ‘ঘুম থেকে কখন উঠলে?’ এ ধরনের খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে আপনাকে সারা দিনই মুঠোফোনে ব্যস্ত রাখত, প্রায়ই দামি দামি উপহার দিয়ে আপনাকে সারপ্রাইজ দিত। কিন্তু এই সুখ আপনার কপালে বেশি দিন সইল না। বছর না ঘুরতেই আপনি যখন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকলেন, তখন সে আপনাকে দেখতে আসা তো দূরে থাক, একটা খবরও নিল না। অথচ আপনাদের সম্পর্ক তখনো বিদ্যমান। আপনি শত ভেবেও বুঝতে পারলেন না আপনার দোষটা কোথায়। সবকিছু পেয়েও কেন হারাতে হলো? ভাবা বন্ধ করুন। আপনি আসলে ‘লাভ বম্বিং’-এর শিকার হয়েছিলেন।
‘লাভ বম্বিং’ হলো কাউকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে তার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখানো কিংবা অতিরিক্ত যত্নশীল আচরণ করা। এটি ম্যানিপুলেটরদের অন্যতম কৌশল। কখনো কখনো আপনার সঙ্গে তাদের আচরণ হয় অত্যন্ত মধুর। তাদের আচরণ দেখে মনে হবে আপনিই তাদের সবকিছু। মধুর আচরণ দিয়েই তারা আপনার বিশ্বাস অর্জন করে। পরমুহূর্তেই দেখা যায়, তারা আপনাকে আর চেনেই না! তাদের লোক দেখানো ক্ষণিকের ভালোবাসা শুধু আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
নিজেদের দোষ এরা স্বীকার করে না। নিজেদের কাজের কোনো দায়ভার এরা গ্রহণ করে না। নিজেদের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং নিজেরাই ভিকটিম সাজে।
এরা নিজেদের দুঃখ–কষ্ট সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে। নাটকীয়ভাবে অন্যদের সহানুভূতি পেতে চায়। নিজেদের কাজের এবং আচরণের কোনো দায়ভার তারা গ্রহণ করে না।
তারা আপনার সহনশীলতা পরীক্ষা করতে চায়। আপনার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করে না। এরা এমন সব কাজ আপনাকে দিয়ে করাতে চাইবে, যেসব আপনি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
তারা খুব সূক্ষ্মভাবে আপনার স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলবে, যাতে আপনি মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক বিষয়ে তাদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বিশেষ করে আপনি যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হন, এদের জন্য সেটি হতে পারে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ, এমনকি দিনের পর দিন নির্যাতন করার একটি সুবর্ণ সুযোগ।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট