১৯৭২ সালে ঢাকায় কম্পিউটার ব্যবহারের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল

বাংলাদেশি কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ সালেহ উদ্দিন আহমদ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন জেরক্স ও আইবিএমে, কম্পিউটারবিজ্ঞানে শিক্ষকতা করেছেন সৌদি আরবের কিং ফাহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭২ সালে ঢাকায় থিসিসের কাজ করতে গিয়ে প্রথম কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পান তিনি। পড়ুন তাঁর সেই অভিজ্ঞতা।

আইবিএম ১৬২০ মেইনফ্রেম কম্পিউটার
ছবি: বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সৌজন্যে

১৯৬৭ থেকে ১৯৭২—আন্দোলন আর সংগ্রামের উত্তপ্ত সেই সময়টাতে আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্বাধীনতার পর অনার্স পাস করে মাস্টার্সে ভর্তি হই।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আমার একজন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম। ইসলাম স্যার তাঁর কসমিক রশ্মি ল্যাবে আমাকে থিসিস করার সুযোগ দেন।

আমি তখন অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলাম। রাজনীতি করতাম—ছিলাম ডাকসুর নির্বাচিত সম্পাদক। দৈনিক পূর্বদেশে খণ্ডকালীন সাংবাদিকতা করতাম। সাহিত্য নিয়েও অনেক সময় কাটাতাম।

ইসলাম স্যারের কসমিক রশ্মি ল্যাবে তখন আমাদের সিনিয়র আরেকজন ছাত্র কাজ করতেন, আনিস সাবেত। তাঁর তখনকার ইচ্ছা ছিল বিদেশে একটা বৃত্তি নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়তে যাওয়া, আর ভবিষ্যৎ ইচ্ছা ছিল ভালো একজন চিত্রপরিচালক হওয়া। চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি অনেক পড়াশোনা করতেন। যাঁরা হুমায়ুন আহমেদের বলপয়েন্ট বইটা পড়েছেন, তাঁরা আনিস ভাইকে ভালোভাবে জানেন। তিনি শুধু নিজেই স্বপ্ন দেখেননি, হুমায়ুন আহমেদকেও সিনেমার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

সালেহ উদ্দিন আহমদ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন (বাঁ থেকে প্রথম)

ইসলাম স্যার ও আনিস ভাইয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলে আমার থিসিসের বিষয়বস্তু ঠিক হলো—কসমিক রশ্মির দৈনন্দিন যে পরিবর্তন হয়, তার একটা থিওরিটিক্যাল মডেল দাঁড় করানো এবং কম্পিউট করে মান বের করা। মডেলটা এত জটিল ছিল যে ফেসিট মেশিন দিয়ে কম্পিউট করা অসম্ভব হয়ে পড়ল।

স্যার একদিন তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন, বললেন, ‘তোমাকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে হবে। অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টারে একটা কম্পিউটার আছে। আমি ইনচার্জ মুসা সাহেবকে চিঠি দিয়ে দিচ্ছি।’

দারুণ ঘাবড়ে গেলাম, ‘জি স্যার,’ বলা ছাড়া মুখে আর কিছু এল না।

প্রোগ্রামিং শেখা শুরু

অ্যাটমিক এনার্জিতে মুসা সাহেবকে বলা হতো কম্পিউটারের ‘ঈশ্বর’। মুসা সাহেব আমাকে কম্পিউটার ব্যবহার করার অনুমতি দিলেন।

অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টারের কম্পিউটারটা সম্ভবত ছিল আইবিএম-৩৬০–এর পূর্বসূরি আইবিএম-১৬২০। বড় বড় সমীকরণ, তার মধ্যে কত কত গাণিতিক ফাংশন, এগুলো কম্পিউটার দিয়ে কীভাবে সমাধান করব! মুসা সাহেব বললেন, ফোরট্রান প্রোগ্রাম লিখতে হবে। ‘ফোরট্রান-২’ প্রোগ্রামিং ভাষা শিখতে হবে।

তখন ইন্টারেকটিভ সিস্টেম ছিল না। প্রোগ্রাম লিখতে হতো পাঞ্চ কার্ডে ছিদ্র করে। প্রোগ্রাম যত বড়, তত বেশি পাঞ্চ কার্ড।

অ্যাটমিক এনার্জির কম্পিউটার সেন্টারে ছিল একটা বিরাট ইনপুট-আউটপুট ইউনিট—তাতে লাগানো ছিল একটা বিরাট টাইপরাইটার।

টাইপরাইটারের ওপরে একটা পাঞ্চ কার্ড লাগিয়ে কিবোর্ড চেপে কার্ডের নির্দিষ্ট জায়গায় ছিদ্র করা হতো, এইভাবে প্রতিটি কার্ডে একটা স্টেটমেন্ট বা নির্দেশ লিখা হতো, পরের স্টেটমেন্টটা আরও একটা কার্ডে। পরে অপারেটররা এগুলো ভেতরে নিয়ে কম্পিউটারে ফিড করত ‘রান’ করার জন্য।

কিন্তু আসল সমস্যা হলো—ফোরট্রান প্রোগ্রামিং করব কীভাবে? আনিস ভাই বললেন—বই খোঁজো, দেখো ফোরট্রান প্রোগ্রামিংয়ের একটা বই পাওয়া যায় কি না!

আমি স্টেডিয়ামের প্রভিন্সিয়াল ও স্ট্যান্ডার্ড বুক স্টোরে হন্যে হয়ে খুঁজলাম। স্ট্যান্ডার্ডের বাতিল করা বইয়ের স্তূপে একটা ফোরট্রান ২–এর বই পাওয়া গেল।

এই সেই পাঞ্চকার্ড

ভুল থেকে শেখা

কয়েক দিনের জন্য আমার অন্য সব কাজকর্ম বন্ধ। থিসিসটা শেষ করতে হবে, সেটাই তখন অগ্রাধিকার। তার সঙ্গে যোগ হলো নতুন এক প্রেরণা—কম্পিউটারের কাজ। ফোরট্রান প্রোগ্রামিং বইটা বারবার পড়ে প্রথমে বুঝতে চেষ্টা করলাম—কম্পিউটারে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ কীভাবে করে; তারপর আরো কঠিন বিষয়গুলো। যেটুকু বুঝলাম তা দিয়ে একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম দাঁড় করিয়ে ফেললাম। কিছু কঠিন বিষয় আনিস ভাইয়ের জন্য রেখে দিলাম। আনিস ভাই আরও কিছু যোগ করলেন।

প্রোগ্রাম নিয়ে বসে গেলাম ইনপুট কার্ডে পাঞ্চ করতে। সেটাও কম বিড়ম্বনার ব্যাপার নয়—আশিটা স্টেটমেন্ট কার্ডে পাঞ্চ করতে দুইটা দিন চলে গেল। সব কটি টাইপ হওয়ার পর ‘রান’ করতে জমা দিলাম। সে সময় সকালে জমা দিলে বলা হতো রেজাল্টের জন্য বিকেলে খোঁজ নিতে। প্রোগ্রাম কখন ‘রান’ করা হবে, সেটা সাধারণত অপারেটরদের মনমর্জি ও কম্পিউটারের সময়সূচির ওপর নির্ভর করত।

যে কদিন এই প্রোগ্রামটা নিয়ে কাজ করেছি, ভীষণ রোমাঞ্চ নিয়ে কেটেছে। ভুলগুলো বুঝতে পারলে ঠিক করে আবার রান করার পর ভালো রেজাল্ট আসত। আবার অনেক ভুল বোঝা খুব কষ্ট ছিল, সেগুলো শুদ্ধ করতে গিয়ে আরও ভুল যোগ হতো।

ভুল শুদ্ধির এই কুস্তিতে আস্তে আস্তে ভুলগুলো হেরে গেল। কোনো ভুল ছাড়াই একদিন রেজাল্ট বের হলো। সেই দিনের আনন্দ ভাষায় বোঝানো যাবে না। মনে হচ্ছিল কার্জন হলের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলি—আমি কম্পিউটারে একটা প্রোগ্রাম লিখেছি।

আমার কম্পিউটারজীবনে কত বড় বড় বাণিজ্যিক সিস্টেম নিয়ে কাজ করেছি, জটিল বিষয় ডিজাইন এবং প্রোগ্রাম করেছি। অনেক কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছি। কিন্তু সেই আশি লাইন প্রোগ্রাম লেখার আনন্দের কাছে অন্য সব ম্লান। এত বছর পরও চোখে ভাসছে সেই পাঞ্চ কার্ডগুলো।