গত ২১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল, যা হয়তো আমরা ভুলে যেতে বসেছি। কিন্তু সেদিন রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যারা আগুনে দগ্ধ হয়ে আজও বেঁচে আছে, তাদের কাছে এ দুর্ঘটনা কোনোভাবেই অতীত নয়।
দুর্ঘটনার ১২ দিন পর, ৩ আগস্ট জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আহ্বানে সিআরপির (সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড) পক্ষ থেকে আমরা সেখানে যাই।
ভেতরে ঢুকতেই যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলাম! যেখানে ফুলের মতো শিশুরা দগ্ধ শরীরের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কারও ৩০ শতাংশ, কারও ৪৭ শতাংশ শরীর আগুনে পুড়েছে। জীবন–মৃত্যুর এক কঠিন বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছে তারা। মা–বাবারা মনে সাহস জোগাচ্ছেন। চিকিৎসার খাতিরে অনেক কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করছে ওরা।
কথা বলতে কষ্ট হয়, তবু তাসনিয়া নামের এক শিশু বলেছিল তার ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের কথা। এক ভীষণ অন্ধকার কক্ষে সে পড়ে আছে, এক কালো পোশাক পরা লোক তাকে ঘোড়ায় করে নিয়ে যেতে চায় দূরে কোথাও। সে ভয় পায়। তাকে সাহস দিই, বলি, এটা কেবলই দুঃস্বপ্ন, বাস্তব নয়।
তাসনিয়া একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। তার কিছুদিন আগে চলে যান স্কুলটির শিক্ষিকা মাহফুজা আক্তার। তীব্র ব্যথায় নাভিদ নামের এক শিশু একটু মরফিনের (ব্যথানাশক) জন্য আকুতি জানাচ্ছিল।
অপর দিকে আইসিইউ থেকে ফিরে আসে তারই বন্ধু আরিয়ান। দিন দিন সুস্থ হয়ে কেউ কেউ বাড়ি ফিরে যায়। আবার কিছু শিশু এখনো সংকটাপন্ন। প্রত্যেক মা–বাবা বুকভরা কষ্ট নিয়ে সন্তানদের বাঁচানোর লড়াইয়ে অবিচল।
আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা পরিচালিত হয় একটি সমন্বিত টিমের মাধ্যমে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের টিমে আমি যখন একজন প্রফেশনাল ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করি, ঠিক তখন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয় যুক্তরাজ্যের একটি ৯ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল। মাইলস্টোনের শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে আসে দলটি। যার মধ্যে দুজন ছিলেন বার্নবিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট।
বলে রাখা ভালো, বার্ন চিকিৎসায় প্রাথমিক থেকে পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অপরিহার্য।
শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত থেরাপি
ফুসফুস সচল রাখতে ও জটিলতা প্রতিরোধে সহায়ক। আগুন ও ধোঁয়ায় আক্রান্ত রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি বার্ন–পরবর্তী চিকিৎসাসংক্রান্ত ধকল সামলাতেও এটি রোগীকে সাহায্য করে।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অবস্থান নির্ধারণ
ক্ষত নিরাময়ের সঙ্গে সঙ্গে সঠিক অঙ্গভঙ্গি বজায় রাখা জরুরি। দীর্ঘ মেয়াদে বিছানায় শুয়ে থেকে তৈরি হওয়া ঘা প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রাথমিক জয়েন্ট মুভমেন্ট
ব্যথা ও জড়তা কমাতে এবং ভবিষ্যৎ চলাফেরার ক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়ক। ক্ষতস্থানে চামড়া প্রতিস্থাপনের পর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন
হয়তো একসময় রোগীর ক্ষত শুকিয়ে যায়, কিন্তু ক্ষতস্থান শক্ত হয়ে এবং জয়েন্ট শক্ত হয়ে শরীর তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতার অধিকাংশই হারিয়ে ফেলে। আগুনে পুড়ে কোনো অঙ্গহানি হলে অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং বিকলাঙ্গতা চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপির কোনো বিকল্প নেই। ধারাবাহিক ফিজিওথেরাপি পুনর্বাসন চিকিৎসা রোগীকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য চিকিৎসা শুধু ক্ষত সারানো নয়; তাদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে আবার দাঁড় করানোই আসল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে ফিজিওথেরাপি একটি আধুনিক, স্বীকৃত এবং অপরিহার্য চিকিৎসা।
একটি দুর্ঘটনা জীবন বদলে দিতে পারে, আবার জীবনকে নতুন পথ খুঁজে নিতে সাহায্য করে ফিজিওথেরাপি। আজ ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবসে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাসেবাকে সারা দেশে প্রতিটি মানুষের জন্য উপযোগী করে তুলতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, বেসরকারি উদ্যোগ, জনসচেতনতা এবং সর্বস্তরের চিকিৎসা পেশাজীবীদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রত্যাশা করি।
তানজির-উজ-জামান, ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সিআরপি, মিরপুর, ঢাকা